সিলেট থেকে: শেন ওয়াটসন প্রসঙ্গ এলেই স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে ২০১১ সালের সেই ১১ এপ্রিল। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে সেদিন ওয়ানডে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান এ ওপেনার। ১৫ ছক্কা আর ১৫ চারে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে খেলেছিলেন ৯৬ বলে ১৮৫ রানের অপরাজিত ইনিংস। এত বছর পরও এ ডানহাতি ব্যাটসম্যানের স্মৃতিতে ভাস্বর সেই মহাকাব্যিক ইনিংসটি। শুক্রবার সিলেট থান্ডারের বিপক্ষে ৩৬ বলে ৬৮ রানের ইনিংস খেলার পথে তার বারবার মনে পড়ছিল ৮ বছর আগের মিরপুরের সেই সুখস্মৃতি।
বঙ্গবন্ধু বিপিএলে প্রথমবারের মতো ওয়াটসনকে নিয়ে এসেছে ইনসেপ্টা রংপুর রেঞ্জার্স। শুরুর পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটিতে জয় পাওয়া দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওয়াটসন আসার পরই। তার নেতৃত্বে শেষ পাঁচ ম্যাচের তিনটিতে জিতেছে রংপুর। শেষ চারে খেলার আশা নিয়ে ঢাকায় ফেরার আগে চ্যানেল আই অনলাইনকে সাক্ষাতকার দিয়েছেন অজি তারকা। কথা বলেছেন বিপিএল নিয়ে, বলতে ভোলেননি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার কথা। নিজের ক্রিকেট দর্শন দিয়ে মূল্যায়ন করেছেন এদেশের তরুণদের সম্ভাবনাকে। জানিয়েছেন নিজের ভবিষ্যতের খুঁটিনাটি।
বিপিএল কেমন লাগছে?
ওয়াটসন: আমি খুবই রোমাঞ্চিত বাংলাদেশে ফিরতে পেরে। ২০১৪ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি এখানে। ক্যারিয়ারজুড়েই দেখেছি এখানকার মানুষ কতটা ক্রিকেটপাগল। প্রথমবারের মতো আমি এই টুর্নামেন্টে (বিপিএল) খেলছি। আমি অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই খেলেছি। তার মধ্যে একটি রংপুর রেঞ্জার্স। দারুণ কিছু মানুষ এই দলটির সঙ্গে যুক্ত। সাপোর্টিং স্টাফ, কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে খেলোয়াড়; একদমই নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। এখানে মোস্তাফিজ, তাসকিন ছাড়াও বিদেশিদের মধ্যে ডেলপোর্ট, গ্রেগরি, অ্যাবেলদের সঙ্গে প্রথমবার খেলছি। একদম নতুন একটা অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমাদের দল ছন্দে ফিরেছে এ মুহূর্তে। সবমিলিয়ে বেশ ভালো লাগছে।
নিজের দলের প্লে-অফ রাউন্ডে খেলার আশা দেখছেন?
ওয়াটসন: হ্যাঁ, দেখছি। আমাদের স্কোয়াডটা খুবই ভালো। এটা জানি যে শেষ দুটি ম্যাচই আমাদের জিততে হবে। তার একটি আবার টপ টিম ঢাকা প্লাটুন, তবে আমাদের দলও বেশ ভালো। আদর্শ টি-টুয়েন্টি গেম বলতে যা বোঝায় – তাই খেলার চেষ্টা করছি সবাই মিলে। মনে হচ্ছে আমরা সেটা পারছি। কে বলতে পারবে সামনে কী হবে? যেহেতু সুযোগ আছে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে চাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলছি। প্লে-অফ খেলব কি খেলব না জানি না। সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেরাটা খেলাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
চার ম্যাচ পর রান পেয়েছেন, খারাপ অবস্থা থেকে নিজেকে কীভাবে বের করে আনলেন?
ওয়াটসন: আমি প্রথম চার ম্যাচ একদমই ভালো করতে পারিনি। ওই ম্যাচগুলোয় মাত্র ১৫ রান করেছি। এই স্কোরই আমাকে ভালো করতে সাহায্য করেছে। কেননা আমি ভালো ক্রিকেট খেলতে চাই। এই চাওয়াটাই আমাকে রান এনে দিয়েছে। ভালো কিছু করতে চাইলে সুযোগ আসবেই।
মিরপুরে ১৮৫ রানের সেই ইনিংসটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই?
ওয়াটসন: অবশ্যই, গতকালও খেলার সময় আমার মনে সেই ইনিংসটা বারবার উঁকি দিয়েছে। আমার ক্যারিয়ারের স্পেশাল মোমেন্ট ছিল সেটা। মনে হচ্ছিল সেই দিনটির মতোই কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে পারিনি। রিকি পন্টিংকেও খুব মনে পড়ছিল। তিনি আমার আইডল। ১৮৫ রানের ইনিংসটা পন্টিংয়ের সঙ্গেই হয়েছিল। আমি ভাগ্যবান, ২২ গজে থেকে আমার ব্যাটিংটা দেখেছিলেন তিনি। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমার জীবনের সেরা সময় সেটাই।
সেই সময় আর এই সময়, কতটা বদলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট?
ওয়াটসন: বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে। তবে সেই উন্নতির মূলে ব্যাটিং। বিপিএলে এসে ব্যাটসম্যানদের উন্নতি খুব চোখে পড়ছে। তরুণ ব্যাটসম্যানরা ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কোয়ালিটি ব্যাটসম্যানকে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। তাদের স্কিল আছে, পাওয়ার আছে। তাদের উঠে আসার পেছনে পেছনে তামিম-সাকিবদের কথা বলতেই হবে। তাদের দেখে যারা আসছে তাদের অনেকেই চোখে পড়ার মতো। আমার দলের নাঈম শেখের নাম করেই বলতে পারি। মাত্র ২১ বছর বয়স অথচ খুবই প্রতিভাবান। হাইস্কিলড ব্যাটসম্যান। সে যদি ধারাবাহিকতা ধরে রাখে, কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দূর যাবে। বাংলাদেশে ক্রিকেটের জন্য অসাধারণ এক প্রতিভা নাঈম।
পেসারদের কেমন দেখলেন?
ওয়াটসন: মোস্তাফিজ-তাসকিন খুবই স্কিলফুল। গতি আছে, পেস আছে। ইবাদত হোসেন, যে গতরাতে আমাকে বোল্ড করেছে (হাসি) সে দুর্দান্ত একজন ফাস্ট বোলার। বাংলাদেশ সব সময়ই ভালো ভালো খেলোয়াড় পেয়ে আসছে এবং বিপিএলে তারা খেলছে। বাইরের ওয়ার্ল্ডক্লাস খেলোয়াড়রাও এখানে খেলছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট শক্তিশালী হচ্ছে।
আর কী করলে বাংলাদেশ ক্রিকেট আরও শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারে?
ওয়াটসন: বাংলাদেশের ক্রিকেট ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। অতীতে তাদের বিপক্ষে খেলেছি। এখন দেখছি অনেক কোয়ালিটি খেলোয়াড় উঠে আসছে। এমন ধারাবাহিকতা খুব ভালো সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। সঠিক একজনকে যদি কোচ করা যায়; তাদের স্কিলের উন্নতিতে সাহায্য করতে… এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান অনেক খেলোয়াড় এখানে আছে। শুধু নিশ্চিত করতে হবে সঠিক কোচকে তাদের পেছনে জুড়ে দেয়া। ঠিকভাবে তাদেরকে যদি কোচরা সাহায্য করতে পারে; তখন তারা বেড়ে উঠবে। তখন অনেক কিছুই ঘটবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
অস্ট্রেলিয়ার সেরা সময়ে আপনি খেলেছেন, নেতৃত্বে তখন পন্টিং। তার অধীনে খেলা কতটা উপভোগ্য ছিল?
ওয়াটসন: অসাধারণ। রিকি পন্টিং আমার আইডল। তার দলে থাকা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার। তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে তার পূর্বসূরিরা এমন একটা দল রেখে গিয়েছিলেন; যা ছিল অসাধারণ। রিকি পন্টিং এমন এক উচ্চতায় দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা ছিল অভাবনীয়। সেই পরম্পরায় অসাধারণ খেলোয়াড়রাই এসেছে। আজকের ওয়ার্নার-স্মিথ যাদের পেয়েছে তারও অসাধারণ। আমি ভাগ্যবান অস্ট্রেলিয়া দলে খেলেছি। যদি সুযোগ পাই তা ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করব। চাইব দেশের জন্য কিছু করতে।
সব ধরনের ক্রিকেট ছাড়ার পর কোচিং হবে আপনার পেশা?
ওয়াটসন: আমি খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে তারপর কোচ হতে চাই। আমি মানুষকে সাহায্য করতে ভালবাসি। অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে আমি কোচিংয়ে সঙ্গে যুক্ত হব। আমি ভাগ্যবান অস্ট্রেলিয়া দলে খেলেছি। আমার খেলোয়াড়ি অভিজ্ঞতা, ক্রিকেট জ্ঞান যদি পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি – তা হবে পরম এক পাওয়া।