ফেনীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার আসামি সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! খোদ তার আইনজীবীও সাংবাদিকদের বলেছেন, হাইকোর্টে জামিন আবেদনের পরে মোয়াজ্জেম হোসেন তাকে (আইনজীবী) আর ফোন করেননি। তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরতে পারছে না। কারণ তিনি লাপাত্তা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘ওসি পালিয়ে থাকলে খুঁজে পেতে হয়তো একটু সময় লাগবে। তবে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।’
একজন পুলিশ কর্মকর্তার এভাবে ‘পালিয়ে যাওয়ার’ ঘটনায় এখন যেসব প্রশ্ন উঠেছে:
১. সরকারি চাকরিতে বহাল থাকা অবস্থায় (ওএসডি বা সাময়িক বরখাস্ত হলেও) প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী (যিনি পদেই হোন না কেন) কী করে লাপাত্তা হন?
২. সাময়িক বরখাস্ত হলেও ওসি মোয়াজ্জেমকে যেখানে বদলি করা হয়েছিল সেখানে তার নিয়মিত হাজিরা দেয়ার কথা। তিনি কি হাজিরা দিয়েছেন? কাগজে-কলমে তিনি কি হাজির না অনুপস্থিত? যদি অনুপস্থিত থাকেন তাহলে দু তিনদিন অনুপস্থিতির পরেই কি তার খোঁজ পড়েনি? যদি পড়ে তাহলে তিনি কোথায় আছেন, কোথায় গিয়েছেন, সেটা জানা পুলিশ বা গোয়েন্দাদের পক্ষে কোনো কঠিন বিষয়?
৩. একজন পুলিশ কর্মকর্তা কোথায় হারিয়ে যাবেন বা লুকাবেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তার চৌদ্দগুষ্টির ঠিকুজি রয়েছে। তিনি কখন কার সাথে কতক্ষণ কী কথা বলেছেন, সেটা বের করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কি ‘ওয়ানটুর’ বিষয় নয়?
৪. তিনি সবশেষ যেখানে (রংপুর রেঞ্জ) দায়িত্বরত ছিলেন, তার উপর মহলের বক্তব্য কী? তারাও কি জানেন না মোয়াজ্জেম হোসেন কোথায় গিয়েছেন?
এরকম আরও অন্তত দশটি প্রশ্ন করা যায় এবং সদিচ্ছা না থাকলে সংশ্লিষ্টদের তরফে এর একটি প্রশ্নেরও সদুত্তর আসবে না। কারণ সমস্যাটা গোড়ায়। ফলে আমরা যদি এখন মোয়াজ্জেম হোসেনকে পুরো সিস্টেমের বাইরে গিয়ে একজন বিচ্ছিন্ন চরিত্র বলে মনে করি এবং সব দোষ এই নন্দ ঘোষের বলে সিদ্ধান্ত দিই, তাহলে আমাদের পুলিশিং সিস্টেম এবং অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ার ভেতরে যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে, সেটি ধরতে পারব না এবং বিষয়টি অনালোচিত এবং অমীমাংসিতই থেকে যাবে।
বস্তুত মোয়াজ্জেম হোসেন শত শত পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি ছোট্ট রিফ্লেকশন। দেশের প্রতিটি বিভাগে, জেলা-উপজেলায়, থানায় থানায় এরকম মোয়াজ্জেমের সংখ্যা অগণিত। তাদের নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। কারণ নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরে তিনি ফেঁসে গেছেন। নুসরাত বেঁচে থাকলে মোয়াজ্জেম হোসেন এখনও হয়তো ওই সোনাগাজী থানায়ই বহাল বতিয়তে থাকতেন। তাকে এখন কাপুরুষের মতো গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হত না। আবার আমাদের দেশে গণকর্মচারীদের (পাবলিক সার্ভেন্ট) যে আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা, তাতে শেষমেষ মোয়োজ্জেম হোসেনের খুব বেশি কিছু হবে বলেও মনে হয় না। বরং রাষ্ট্রের শীর্ষ মহলও নুসরাত ইস্যুতে সংবেদনশীল এবং সিরিয়াস বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা মূলত ‘ধরা খেয়ে’ গেছেন। কেননা তারা প্রতিনিয়ত এর চেয়েও ভয়াবহ সব কাণ্ড করেন—যা গণমাধ্যম তো দূরে থাক, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও আসে না।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবি এক বিবৃতিতে বলেছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই মোয়াজ্জেম হোসেনের পালিয়ে যাওয়ার খবর উদ্বেগজনক। এতে ওসি মোয়াজ্জেমের ভূমিকার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে পুলিশ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, যা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রীতিমতো অশনিসংকেত বলে মনে করে টিআইবি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত ব্যারিস্টার সুমনের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাবেক এই ওসির বিরুদ্ধে গত ২৭ মে পরোয়ানা জারির পর তা ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয় হয়ে রংপুর রেঞ্জে পৌঁছাতে সময় লাগে এক সপ্তাহেরও বেশি। আবার পুলিশের রংপুর রেঞ্জ বলেছে, কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি। বস্তুত সরকারি দপ্তরের এই আমলাতন্ত্রের সুযোগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ‘পালিয়ে গেছেন’ কিংবা আরও পরিস্কার করে বলা যায় তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো তিনি কি দেশেই আছেন নাকি সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। বিদেশে গেলে ইমিগ্রেশন সেই তথ্য থাকবার কথা। যদি না গিয়ে থাকেন তাহলে সরকার কি সব বিমানবন্দর ও পোর্টে তার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে যাতে তিনি পালিয়ে যেতে না পারেন? নাকি তাকে বিদেশে পালিয়ে যেতেও সহায়তা করা হবে?
এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দেয়া যায় যে, দেশে যখনই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাতে তার পরিচয় যাই হোক, পুলিশ মোটামুটি কালক্ষেপণ না করেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে। অনেককে গ্রেপ্তারের পরে মামলা দেয়া হয়েছে। অথচ সারা দেশে তোলপাড় করা একটি ঘটনায় আলোচিত মামলার আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। বরং এখন বলছে তিনি পলাতক। একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ভাইব্রাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবেন, এটিও এখন দেশবাসীকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। এই মামলার বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও মনে করেন, মোয়াজ্জেম হোসেনকে ধরতে দেরি হলে বা না ধরলে দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।
মূলত নানা কারণেই আমাদের পুলিশিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কম। এখনও পুলিশ ওই অর্থে জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু নিয়মিত বিরতিতে তাদের এমন সব কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হয় যা পুলিশ সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতি ও আতঙ্ক বহুগণ বাড়িয়ে দেয়। অথচ জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত রাষ্ট্রের সবচেয় বড় এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও এই বাহিনীর হাতে নিরীহ মানুষের নাজেহাল হওয়া, এক পক্ষের কাছ থেকে পয়সা খেয়ে অন্য পক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়া, পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত রিপোর্ট তৈরিসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। যদিও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, পুলিশ বাহিনীতে সৎ অফিসারের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু সেই সংখ্যা কত? বিশেষ করে প্রতিটি থানায় প্রতিনিয়ত যেসব ঘটনা ঘটে, তার নির্মোহ বিশ্লেষণ করলেই তার উত্তর মিলবে। সুতরাং আলাদা করে একজন মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে আলোচনা বা ফেসবুকের ওয়াল উত্তপ্ত করাই যায়, তাতে সামগ্রিক সিস্টেমের কোনো পরিবর্তন হবে না। তার জন্য দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)