করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়েছে ওমিক্রন প্রকোপ। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট। যা থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক পরা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজের দিকে ঝুঁকেছে পুরো বিশ্ব।
বাংলাদেশেও যেহেতু ঢুকে পড়েছে ওমিক্রন, ৬০ বছরের বেশি বয়সী ও ফ্রন্টলাইনারদের অগ্রাধিকার দিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে বুস্টার ডোজ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ হিসেবে দেশে দেওয়া হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন৷ বুস্টার ডোজ নিতে যারা যোগ্য, তারা আগে দুই ডোজ যে ভ্যাকসিনই নিয়ে থাকুন না কেন, তৃতীয় ডোজে তাদের দেওয়া হবে ওই তিন ভ্যাকসিনের মধ্যে যেকোন একটি৷
এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন গ্রহীতার বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। বিষয়টি নিয়ে জনমনে রয়েছে কিছুটা দোলাচাল।
ওমিক্রনের প্রভাব ও বুস্টার ডোজ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের কথা হয়েছে বাংলাদেশি-মার্কিন চিকিৎসক ডা. রুমি আহমেদ খানের সঙ্গে, বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে অবস্থিত রিজিওনাল মেডিক্যাল সেন্টারে মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ক্ষতিকর নানা দিক নিয়ে ডা. রুমি বলেন: চীনের উহানে যে প্রথম ভাইরাসটা পাওয়া গিয়েছিল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি তার একটা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত সংস্করণ| ওমিক্রনের গায়ে যে স্পাইক আছে, তার মাধ্যমে এটি অনেক দ্রুত আমাদের কোষে ঢুকতে পারে। স্পাইক প্রোটিনে কম-বেশি ত্রিশটি আর রিসেপ্টর প্রোটিনে আরও প্রায় বিশটি মিউটেশন নিয়ে মাঠে হাজির ওমিক্রন।
তিনি জানান: এতসব মিউটেশনের ফলে বেশ কিছু আচরণগত পরিবর্তন এসেছে এই ভাইরাসে! ভ্যারিয়েন্টটি আমাদের নাকের সেলে প্রচুর পরিমাণে অবস্থান করতে পারে, যার ফলে এটি অনেক বেশি ছোঁয়াচে! এটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড অনেক কম- মাত্র তিনদিন!
ক্ষতিকর দিকগুলোর পাশাপাশি ওমিক্রন বিষয়ে আশার কথাও শুনিয়েছেন এই চিকিৎসক। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন আসাতে ওমিক্রন মারাত্মক ছোঁয়াচে হয়েছে ঠিক, কিন্তু কমেছে তার কোষের বেশি ভেতরে প্রবেশের ক্ষমতা। এর ফলে এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের ফুসফুসের কোষে খুব সহজে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ওমিক্রনে আক্রান্তদের সিরিয়াস নিউমোনিয়ার শঙ্কা অনেকটা কম। তবে মনে রাখতে হবে, আমি বলেছি নিউমোনিয়া হবার শঙ্কা কম- কিন্তু শূন্য না। এখনও অনেকের নিউমোনিয়া হবে, তিন ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া নাই এমন অনেকের মৃত্যুও হতে পারে।
মাস্ক পরার সাথে সাথে বুস্টার ডোজকে করোনা মোকাবিলার হাতিয়ার জানিয়ে ডা. রুমি আহমেদ খান বলেন: আমি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি করোনাভাইরাস বাতাস বাহিত ভাইরাস। কাজেই অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, বিশেষ করে এন ৯৫ বা কে এন ৯৫ টাইপের কয়েক লেয়ারযুক্ত মাস্ক। জনসমাগম যেখানে খুব বেশি ও বদ্ধ পরিবেশে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, খোলামেলা পরিবেশ কিছুটা নিরাপদ।
বুস্টার ডোজের প্রতি ইতিবাচক মত ব্যক্ত করে তিনি বলেন: করোনাভাইরাসের ব্যাপক মিউটেশন হলেও আগের ভ্যাকসিনগুলোই খুব ভালো কাজ করছে, যা ওমিক্রনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা আসলেই সুসংবাদ। তবে বুস্টার ভ্যাকসিন মানে তিন ডোজ ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকলে কাউকে এখন আর পুরোপরি ভ্যাকসিনেটেড বলা যাচ্ছে না! তিন ডোজ এমআরএনএ ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রন্ত হলেও সিরিয়াস অসুস্থতা থেকে প্রতিরোধে প্রায় ৯০% কার্যকর!
বাংলাদেশে বুস্টার ডোজ শুরুর বিষয়টিকে সরকারের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে ডা. রুমি উল্লেখ করেন।
দেশে শুরু হওয়া বুস্টার ডোজে ‘মিক্সড’ ভ্যাকসিনের বিষয়টি তিনি খেয়াল করেছেন। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত মিক্সড ভ্যাকসিন রিকমান্ড করেনি, প্রতিবেশী দেশ ভারতও মিক্সড ভ্যাকসিন দিচ্ছে না; তাহলে এটি নিরাপদ কিনা’, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন: এটি শুধু নিরাপদই না, মিক্সড ভ্যাকসিন অনেক বেশি কার্যকরও। সম্প্রতি অনেকগুলো গবেষণা কোভিড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে তৃতীয় ডোজ মডার্না বা ফাইজার এর অধিকতর কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে।
মিক্সড ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ব্যাপকহারে প্রয়োগ হচ্ছে জানিয়ে ডা. রুমি আহমেদ খান বলেন: হেটারোলোগাস প্রাইম বুস্ট বা মিক্স ম্যাচ ডোজিং ভ্যাক্সিনোলজির একটা প্রমাণিত বিষয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা প্রথমে কোভিশিল্ড টাইপের ভ্যাকসিন নিয়েছেন তারা যদি তৃতীয় ডোজ যদি মডার্না নেন, তাদের ৭৮ গুণ বেশি এন্টিবডি হয়েছে তৃতীয় ডোজ কোভিশিল্ড এর তুলনায়! আবার অন্য সব ভ্যাকসিনের ক্ষেত্ৰও দেখা গেছে যে বুস্টার ডোজ ভিন্ন- যেমন ফাইজার নিলে অনেক ভালো ইমিউন বুস্ট হচ্ছে।
ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে গণহারে হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুর হার কম বলে দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সবাইকে সচেতন হবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রবাসী এই চিকিৎসক।