শরীর থেকে ১২ কেজি ওজন কমিয়েছেন মাত্র দুই মাসে! ভাতের বদলে খাচ্ছেন পাস্তা আর জুস। ভাত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। যার ফল পাচ্ছেন শাহাদাত হোসেন রাজিব। ওজন কমায় গতি যেমন বেড়েছে, বলও পাচ্ছে সঠিক নিশানা। নেটে ব্যাটিং করে এই পেসারের বোলিংয়ের ঝাঁঝ টের পেয়েছেন তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম।
একাডেমি মাঠে গল্পের ছলে দেশসেরা দুই ব্যাটসম্যানই বলেছেন শাহাদাতের বোলিংয়ে উন্নতির কথা। তাতে জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন আরও বড় হয়েছে ৩১ বছর বয়সী এ ডানহাতি পেসারের।
২০১৫ সালের ৬ মে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে ডেলিভারির আগেই পা পিছলে মাটিতে পড়লে হাঁটুর লিগামেন্ট ছিড়ে যায় শাহাদাতের। অস্ত্রোপচারের ধকল ও গৃহকর্মী নির্যাতনের জেরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরতে লেগে যায় এক বছর। তবে ফেরা হয়নি জাতীয় দলের আঙিনায়। গত মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলার সুযোগ পেয়েছেন কম। চেনা কক্ষপথ থেকে সরে যাওয়া এ পেসার আগামী মৌসুমে পারফরম্যান্স দিয়েই ফেরার স্বপ্ন দেখেন টেস্ট দলে।
শনিবার নেটে বোলিং শেষে জিমে এসে ওজন তুলতে তুলতে শাহাদাত কথা বললেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে। শরীর থেকে তখন অনবরত ঘাম ঝড়ছিল। শাহাদাতের কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার ছবি মূর্ত হয়ে উঠল তার চেহারা ও শরীরী ভাষায়। হঠাৎ এত সিরিয়াস? শাহাদাত শোনালেন অনুপ্রেরণার গল্প।
গত সপ্তাহে নেটে মাশরাফীর সঙ্গে বোলিং করেছেন শাহাদাত। বোলিংয়ের ফাঁকে তাকে ওয়ানডে অধিনায়ক দিয়েছেন নানা টিপস আর উৎসাহ। শাহাদাতের ভাষায়, ‘মাশরাফী ভাই বলেছিলেন ওজন কমাতে হলে ভাত খাওয়া ছাড়তে। খুব কাজে দিয়েছে। বল ডেলিভারির সময় অন্য হাত একটু বেঁকে থাকত সেটা সোজা রাখতে বলেছেন। তাহলে নাকি গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার বাড়বে। গতি বেড়েছেও। মাশরাফী ভাইয়ের আরেকটা কথায় চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। বলছিলেন, আমি এতগুলো সার্জারি নিয়ে খেলছি আর তোর তো মাত্র একটা। সে কথা শোনার পরই পরিশ্রম বাড়িয়ে দিয়েছি।’
শাহাদাতের স্বপ্নের বেলুনে জোর হাওয়া দিয়েছেন মাশরাফী। ফেরার চ্যালেঞ্জ নিয়ে করে যাচ্ছেন কঠোর পরিশ্রম। ফেরার তাড়না অনুভব করছেন আরও একটি কারণে। সেটি হল টেস্ট দলে পেসারের হাহাকার।
শাহাদাত জাতীয় দল থেকে বের হওয়ার পর মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া কোনো পেসারই নিয়মিত হতে পারেননি টেস্ট দলে। পেসারদের অবস্থা পোড়ায় শাহাদাতকে। যে কারণে টেস্ট নিয়ে ভাবছেন।
টেস্টে একজন পেসারকে ভালো করতে হলে এই ফরম্যাটের প্রতি আলাদা ভালোবাসা দরকার। আমার তো ওয়ানডে বা টি-টুয়েন্টির প্রতি আকর্ষণ নেই। সবসময়ই চাই টেস্ট খেলতে। টেস্টের প্রতি ভালোলাগার বিশেষ জায়গা আছে। আমি মনে করি, যদি পারফর্ম করতে পারি আরও ৫ বছর দেশের হয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ থাকবে। যে কারণে হাল ছাড়ছি না। আমাকে ফিরতে হবে।’
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক করা শাহাদাত প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে নাম তুলেছিলেন লর্ডসের অনার্স বোর্ডেও। তখনকার সম্ভাবনাময় এই বোলার যখন পেছনের কীর্তির দিকে তাকান ঝড়ে আক্ষেপ, ‘ইনজুরিতে না পড়লে হয়ত এতদিনে নামের পাশে একশ টেস্ট উইকেট থাকত।’
শাহাদাতের বড় আক্ষেপ তার বিকল্প তৈরি না হওয়ায়। মোস্তাজিুর রহমান ছাড়া পেসারদের মধ্যে কেউই থিতু হতে পারেননি এই সময়টায়। ৩৮ টেস্টে ৭২ উইকেট শিকারি শাহাদাত এখনও পেসারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। এক নম্বরে মাশরাফী ৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট। নড়াইল এক্সপ্রেস সবশেষ টেস্ট খেলেছেন ২০০৯ সালে। তারপরও অন্য কোনো পেসার ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
মাশরাফী-শাহাদাত ছাড়া টেস্টে ৫০ উইকেট শিকার করেছেন এমন পেসারও নেই। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ উইকেট নিয়েছেন তাপস বৈশ্য। এই পেসার খেলা ছেড়েছেন ২০০৫ সালে। যে পরিসংখ্যানই স্পষ্ট করে টেস্টে বাংলাদেশের পেসারদের কী বেহাল অবস্থা!
‘আসলে এটা খুবই দুঃখ লাগে যে এখনো পেস বোলার টেস্টে নিজের নামের পাশে একশ উইকেট নিতে পারেনি। আমি তো এ জন্যই এখন দিন-রাত অনুশীলন করে যাচ্ছি। মাশরাফী ভাই আমাকে বলেছেন তুই এখনো পারবি। আমিও বিশ্বাস করি মন থেকে ক্রিকেট খেলে গেলে আমি পারবো। আমি চাই আমার নামের পাশে একশ উইকেট থাকুক।’
শাহাদাত উপলব্ধি করেন টেস্ট খেলতে হয় মন থেকে। তেমনটা না হলে পারফর্ম করা যায় না, ‘দেখেন, আমরা যখন খেলি তখন কিন্তু এতটা সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তখন আমরা যারা খেলি তখন সবে বাংলাদেশ টেস্ট আঙ্গিনায় পা রেখেছে। শুরু থেকেই আমরা জান প্রাণ দিয়ে খেলতাম। টেস্ট ক্রিকেটটা আসলে খেলতে হয় মন থেকে। তখন যারা খেলেছেন তারা মন থেকে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। যেমন মাশরাফী ভাই, তাপস ভাই, আমি নিজেও। অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিপক্ষে খেলেছি, ভয় পাইনি। এখন দেখেন কয় জন পেসারের মধ্যে সেই আগ্রাসন আছে?’
‘এটিও ঠিক যে, আমাদের টেস্ট ম্যাচ ছিল কম। ঘরের উইকেটেও পেস সহায়ক ছিল না। পেসারদের তেমন মূল্যায়ন হত না। ইনজুরির সমস্যা আগেও ছিল, এখনো আছে। তারপরও আবার টেস্টে এক পেসার নিয়ে খেলা হয়েছে। আমরা কিন্তু যে সুযোগ পেয়েছি বাঘা বাঘা দলের বিপক্ষে উইকেট পেয়েছি। আসলে মন থেকে খেলেছি বলেই এমনটা পেরেছি।’ -যোগ করেন শাহাদাত।
এখনকার পেসাররা টেস্টে ভালো করতে না পারার পেছনে টি-টুয়েন্টির আগ্রাসনের প্রভাব আছে বলেও মত শাহাদাতের, ‘একটা সময় ছিল টেস্ট আর ওয়ানডে। অনেক পেসারই ছিল যারা শুধু টেস্টেই খেলতো। যেমন আমি কিন্তু বেশি টেস্টই খেলেছি। তাই চিন্তা ছিল ভালো না করলে বাদ পড়লে কি হবে! এখন পেসারা চিন্তা করে টেস্ট না খেললে ওয়ানডে আছে, টি-টুয়েন্টি আছে। আবার অনেকেই ইনজুরির ভয়ও পায়। টেস্টে বেশি এফোর্ট দিতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়লে পরে ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি খেলা হবে না। আমি মনে করি কিছুটা হলেও টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট টেস্টের পেস বোলারদের উপর প্রভাব ফেলেছে।’