চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ওই দেখা যায় পদ্মা সেতু, ওই আমাদের গাঁ

খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের ‘কানা বগীর ছা’ কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ/ওই আমাদের গাঁ/ওই খানেতে বাস করে কানা বগীর ছা’। দক্ষিণ বঙ্গের ২১টি জেলার মানুষেরা এতদিন যেন সেই ‘কানা বগীরা ছা’ হয়েই ছিল।কিন্তু নানা বাধা-বিপত্তি ও সকল জল্পনা-কল্পনা আর নিরাশার অবসান ঘটিয়ে পদ্মার বুক চিড়ে যখন সত্যি সত্যিই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাদের স্বপ্নের সেতু, সেই ‘কানা বগীর ছা’রা যেন সত্যিই আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে চোখে। শনিবার শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সকল দুঃসপ্নের অবসান হলো।

বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কিছু কারণে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই প্রকল্পের কাজ তদারকি বিষয়ে পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে এসএনসি-লাভালিনের কর্মীরা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, এমন  অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। শুধু তাই নয়, এরপর একে একে অন্য সহযোগীদেরও এই প্রকল্প থেকে সরিয়ে নেয় তারা। এর ফলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এমনকি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পরবর্তীতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র থাকার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোন প্রমাণ পাননি কানাডার আদালত। অথচ ভুয়া অভিযোগ তুলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছিল তারা। তাই স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার খবর বাংলাদেশের জন্য গর্বের, দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের জন্য আনন্দের।

রাজধানী আসতে-যেতে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের যাত্রাপথে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে কেবল পদ্মা পার হতেই। উৎসব-পার্বণের সময় ফেরি বিকল যানজটসহ তাদের ভোগান্তির যেন কোন শেষ নেই। তাছাড়া ‘ঘাটের মানুষদের’ দ্বারা যাত্রাপথে হয়রানির শিকার হননি এমন মানুষও পাওয়া যাবে না হয়তো।

প্রতিবছরই নদী পার হওয়ার সময় লঞ্চডুবিতে মারা যায় মানুষ।পারাপারের ভাড়া নিয়ে ঘাটের ইজারাদারদের নৈরাজ্য, তাদের চেলা-চামুণ্ডাদের দ্বারা নিগৃহীত হওয়াসহ নানা ধরনের হয়রানিতে মানুষ পুরোপুরি জিম্মি।এ ধরনের হয়রানির শিকার মানুষদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘পদ্মা সেতু হোক, তারপর দেখবো তোমাদের এ বাহাদুরি কোথায় থাকে’। সেই নিগৃতীত মানুষের মনে এখন সত্যিই আশার সঞ্চার হয়েছে যেন।

পদ্মা সেতুর প্রভাব নিয়ে সরকারের করা সম্ভাব্যতা জরিপের তথ্য, শুধু যোগাযোগেই নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে সেতুটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচে করা এ মহাপ্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে ওই গবেষণায় দাবি করা হয়, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের আয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে। আর ৭ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে।

দেশের মানুষের মনে এত আশার সঞ্চার করে নিজস্ব অর্থায়নে মাথা তুলে তুলে দাঁড়ানো এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানকে দেশবাসী তুলনা করছেন জাতির দুঃসাহসের এক একটি মেরুদণ্ড হিসেবে। আর দক্ষিণ বঙ্গের মানুষরা যেন নিজেদের বাড়িকে ঢাকা থেকে আরও কাছে দেখতে পেয়ে ‘কানা বগীর ছা’ কবিতাটি উচ্চারণ করছে নিজের মত করে। ‘ওই দেখা যায় পদ্মা সেতু, ওই আমাদের গাঁ…’