চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ঐশীর ফাঁসির দণ্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন

সম্প্রতি শিশু রাজন, রাকীব হত্যার দ্রুত বিচার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডারেরও দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পুলিশ দম্পতি হত্যাকারী তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকেও ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে।

এসব ঘটনায় এক ধরেনর চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একথা ঠিক যে, সমাজে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডই কাম্য নয়। আর যে কোনো কারণে হত্যাকাণ্ডের মত গুরুত্বর অপরাধ সংঘটিত হলে এর দ্রুত বিচার চান সবাই।

সম্প্রতি রাজন-রাকিব ও পুলিশ দম্পতি হত্যার দ্রুত বিচার নিঃসন্দেহে সমাজের জন্য ইতিবাচক দিক। হত্যার দায়ে দেশের প্রচলিত আইনে এমন শাস্তিই ন্যায় বিচার। আমাদের সমাজে অপরাধীদের বিচার এবং সাজা হয় না বলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যার জন্য কিশোরী ঐশীকে আদালত ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে। বয়স বিবেচনায় ঐশীকে এই দণ্ড প্রদান করাটা ঠিক হয়েছে কি-না, সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। আসলে যে কোনো আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, জনসাধারণের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা ও অপরাধীদের শাস্তি বিধান। সামাজিক সুরক্ষা যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা নিয়ে যেমন কোনও তর্ক থাকতে পারে না, তেমনই অপরাধ করলে শিশুদেরও যে শাস্তি প্রাপ্য, তা নিয়েও মত দ্বৈততা নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঐশীকে যে দণ্ডটা দেয়া হলো, এই ‘দাওয়াইয়ে’ আসল ‘অসুখটা’ সারবে তো? পৌঁছনো যাবে তো সমস্যার গোড়ায়? যদি তা না যায়, তা হলে যে দুরপনেয় ‘চিকিৎসা-সংকট’ ঘটে যাবে, তার দায়ভার নেব তো আমরা?

প্রথমেই আসা যাক ঐশীর ঘটনাটিকে আর দশটা ফৌজদারী অপরাধের মতো দেখে সাধারণ আইনে বিচার ও দণ্ড দেওয়াটা ঠিক হয়েছে কি না? শিশু অপরাধ ও তার প্রতিবিধান-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, যে সব কিশোর অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত সাজা-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফের অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা অনেক গুণ বেশি।

সেসব সমীক্ষার ফলাফল সামনে আসার পর অনেক দেশেই কিশোর অপরাধীদের প্রথাগত শাস্তি বিধানের নিয়মকানুন পাল্টে ১৮ বছর বয়সকে শৈশবের সীমা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

শিশুদের মানসিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার প্রভাব (যাকে আমরা ব্যাপক অর্থে সামাজিক প্রভাব বলি), তাদের জীবনে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ঢের বেশি। অনেক ক্ষেত্রে তারা পরিণাম না বুঝে কোন পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে তারা তুলনায় বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা চালিত হয় বিষয়টির গুরুত্ব না বুঝে, বা আচরণের সম্ভাব্য ফলাফল ও পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হয়েই।

সেদিক থেকে দেখলে তাদের মানসিক বিকাশ ও দায়িত্ব নিতে শেখার পিছনে, তাদের চেয়ে বরং সমাজের দায়-দায়িত্বই থাকে বেশি। সেখানে যদি কোনো ফাঁক রয়ে যায়, ভবিষ্যতে তার ফল হতে পারে মারাত্মক। এ প্রসঙ্গে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৮৯-এ জাতিসংঘের কনভেনশন অব চাইল্ড রাইটস-এর নির্দেশিকায় খুব স্পষ্ট ভাবে শৈশবের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে ১৮ বছর, এবং সেই নির্দেশনামায় সই করে তার ভাগীদার হয়েছে বাংলাদেশেও।

সেই নির্দেশিকায় ১৮ বছরকে কেন শৈশবের সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো, সেটাও একটু বুঝে নেওয়া আবশ্যক। এ কথা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত যে, এই বয়সেই একটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, ধারণাগত ও আবেগীয় (ফিজিক্যাল, মেন্টাল, কগনিটিভ অ্যান্ড ইমোশনাল) বিকাশ মোটামুটি একটি পর্যায়ে পৌঁছায়।

এটাই পূর্ণতাপ্রাপ্তি কি না, তা নিয়ে অবশ্য মতান্তর আছে। তবে শিশু মনস্তাত্ত্বিক থেকে সমাজতাত্ত্বিক পর্যন্ত প্রায় সকলেই দ্বিধাহীন ভাবে একমত যে, ১৮-র আগে এই পরিণতি আসা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণেই কিশোর অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া প্রাপ্তবয়স্কদের বিচারের থেকে আলাদা হওয়া জরুরি, এমনকী সংশোধনাগারেও তাদের রাখা উচিত প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের থেকে আলাদা করে।

বাস্তবেও সেটাই হয় এবং এর পিছনেও যুক্তিটা সেই একই। ঐশীর ক্ষেত্রে উল্লিখিত যুক্তিগুলো ঠিকঠাকমতো মানা হয়েছে কিনা-সেটা নিয়ে রয়েছে গভীর সংশয়। ঐশীর অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠার গল্পটা আমাদের খুব ভালোভাবে বোঝা উচিত। তার লেখা ‘সুইসাইড নোট’ পড়লে বিষয়টা বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে।

বাবা মাকে নিয়ে লিখেছে-‘তারা কোন দিনও আমাকে বুঝতে পারেনি। আমার অনেক খারাপ দিক আছে- সেই খারাপ দিকগুলো চালাকি করে বুঝে ফেলা ছাড়া ভালো দিক গুলো কখনোই তারা বোঝার চেষ্টা করেছে কিনা সন্দেহ।’ বাবা-মা’র বিরুদ্ধে এটা নিঃসন্দেহে কঠিন অভিযোগ। এই অভিযোগটির তাৎপর্য অনুধাবন করে দেখা দরকার। ঐশীর এই হন্তারক হয়ে উঠার পেছনের কাহিনি ভালোভাবে বুঝতে না পারলে আমরা ভবিষ্যৎ ঐশীদের জীবনকে সুন্দর করতে পারব না।

যে ঐশীকে আমরা তৈরি করেছি সে তার বাবা মাকে খুন না করলে হয়তো নিজেকেই খুন করতো! মনে রাখতে হবে, একজন মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও তার বাবা মাকে খুন করতে পারে না! বাবা মাকে শুধু ভালোবাসা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়, খুন করা যায় না। যদি কেউ করে তাহলে বুঝতে হবে তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুতর কোন সমস্যা আছে! সে সমস্যা দূর করার চেষ্টা না করে, তাকে সুস্থ করার চেষ্টা না করে শুধু একজন ঐশীকে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টা করলে নিজেদের দায় মোচন হবে না।

একজন অপরাধীকে অপরাধ প্রবণ মানসিকতা থেকে ফিরিয়ে আনাটাই সবচেয়ে বড় সার্থকতা। যে কাজটি করতে আমরা শোচনীয় রকম ব্যর্থ হচ্ছি। ঠাণ্ডা মাথায় দীর্ঘ সময় নিয়ে ঐশী প্রথমে মাকে হত্যা করে। পরে বিপদ হবে জেনে ছুরি দিয়ে খুন করে বাবাকে।

এর আগে দুজনের কফির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় ঘুমের ওষুধ। একটা মেয়ে কতটা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হলে এই কাজটি করতে পারে? দেখা গেছে, ঐশীর বড় হয়ে উঠার মধ্যেই রয়ে গেছে বড় ধরনের গলদ! এই দায় নিতে হবে পরিবারের সদস্যদের। নিতে হবে সমাজের অপরাপর সকলকে।

আমাদের দেশে এখন এমন অনেক পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের বড় বেশি মিলমিশ নেই। দেখা-সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়েই অনেক বাবা-মা তাদের দায়িত্ব পালন করেন। নিজেরা ছোটেন অর্থ-বিত্ত আর ভোগবিলাসী এক অলীক জীবনের পেছনে।

পারিবারিক স্নেহ-মায়া মমতাহীন প্রাচুর্য নির্ভর এই পরিবেশ সন্তানকেও উচ্ছন্নের পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। শিশু কিশোররা নিজেদের মতো সৃষ্টি করে এক ফ্যান্টাসীর জগৎ, নেশা আর ভোগ-বিলাসের উপাদানে ঠাসা এক অলীক পৃথিবী। যে পৃথিবীতে সহানুভূতি-মানবিকতা-সংবেদনশীলতা ও বিবেকহীন এক নিজস্ব চাহিদা ও ভালোলাগা নির্ভর যান্ত্রিক জীবন তৈরি হয়। যে জীবনে একটু ছন্দপতন ঘটলে, কিংবা তার আশঙ্কা দেখা দিলেই তারা বিগড়ে যায়!

যেমনটা ঘটেছে ঐশীর ক্ষেত্রে। পরিবারের সাহচর্য না পেয়ে সে জড়িয়ে পড়েছিলো অসৎ সঙ্গে, আসক্ত হয়ে পড়ে মরণ নেশা ইয়াবায়। মা-বাবা যখন বাধা দিতে আসেন তখন জল গড়িয়েছে অনেকদূর। তখন সে হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর। শেষ পর্যন্ত বাবা-মাকে খুন করে তার ক্ষোভ চরিতার্থ করে।

ঐশীর এই পরিণতি আমাদের সবাইকে বিবেকের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা কী আমাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছি? মানবিক সমাজ গঠনে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করছি? আমাদের অবহেলা-উদাসীনতায় দেশে হাজার হাজার লাখ-লাখ কিশোরকিশোরী বেড়ে উঠছে ঐশীর মতো অধঃপতিত, অপরাধপ্রবণ মানসিকতা নিয়ে।

বাবা-মার ব্যস্ততা আর উদাসীনতার সুযোগে রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারি পরিবেশ এবং বন্ধুর খালি ফ্ল্যাটে ঘটছে নানা ঘটনা। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় সোনালি ভবিষ্যৎ। কেউ কেউ ভয়ংকর হয়ে উঠছে ঐশীর মতোই। শিশু কিশোররা এখন যন্ত্রপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে নানা বিকৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মনের জানলায় ভিন্ন এক জগৎ উঁকি দিচ্ছে। অনেকে বাবা-মার উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে, অনেকে আবার তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের জগৎ সৃষ্টি করছে।

এই জগৎ কাম, বিকৃতি আর নানা নেশার সামগ্রীতে থাকছে ঠাসা। বয়ঃসন্ধিতে যদি ভালো-মন্দের একটা ছবি কিশোর কিশোরীদের সামনে তুলে ধরা না হয়, তাহলে তারা ভুল পথে যাবে। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে মা-বাবাকে, পরিবারের সদস্যদেরকে। বুঝতে হবে শিশু কিশোরদের মনস্তত্ব।

কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে, জোর করে কিছু করাতে চাইলে কিংবা কোন কিছু করতে বাধা দিলে তাদের মধ্যে জেদ চেপে যেতে পারে। তারা প্রতিহিংসা পারায়ণ হতে পারে। এজন্য তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। না হলে এক ঐশীর ফাঁসি দিয়ে সমাজের পরিবর্তন সহজে হবে না। বরং একেকটি ‘সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়’ হত্যার দায় ও গ্লানি নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)