চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো বাঙালিয়ানা, আবহমান গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। প্রান্তর জুড়ে সারি সারি কুঁড়েঘর। তৈরি হচ্ছে বাহারি রঙের জামদানি শাড়ি। কিছু জামদানি শাড়ি শোভা পাচ্ছে কুঁড়েঘরের দেয়ালে। এমন কয়েকটি কুঁড়েঘরে দেখা মেলে রিক্সা পেইন্টিং আর মৃৎশিল্প সামগ্রী। কোথাও বোনা হচ্ছে নকশিকাঁথা। আর মাঠের উত্তরপাশের বিশাল মঞ্চে শ্রোতা উদ্দীপ্ত কনসার্ট, ফ্যাশন শোসহ নানা আয়োজন। আবহমান গ্রামীণ জীবনের নানা পসরার সাথে লোকজ গান, পোশাক ও কারুশিল্পের প্রদর্শনীতে মুগ্ধ দর্শক।
স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে ছোট বড় সবাই উপভোগ করছে দেশীয় লাইফ স্টাইল ব্র্যান্ড আড়ংয়ের ৪০ বছর সেলিব্রেশন উৎসব। চার দশকের পথচলা বাণিজ্যিক ও সামাজিক যে কোন প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাশন সচেতন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে ভর করে আড়ং এই বছর ৪০ বছর পূরণ করেছে তাদের পথচলার।
গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষদের বিশেষ করে নারীদের অর্থনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসতে ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করা আড়ং বর্তমান সময়ে দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, বড় এবং বিশ্বস্ত রিটেইল চেইন ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল ব্র্যান্ড হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। খাঁটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে আড়ং এখন সফলতার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সম্প্রতি তাদের ৪০ বছরের সফলতাকে উদযাপন করতে আড়ং আয়োজন করে তিন দিনের উৎসব। ‘আড়ং ফোরটি ইয়ারস ফেস্টিভাল’ শিরোনামের এই উৎসব বসে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে ২৫- ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ।
এই উৎসব ঘিরে দেখা যায় মানুষের গভীর আগ্রহ। দেশীয় পোশাক শিল্পের সবকিছুই ছিল এই উৎসব আয়োজনে। পোশাক প্রদর্শনী বিশেষ করে দেশীয় তাঁতে তৈরি, কারুশিল্প, রিকশা চিত্র, ফ্যাশন শো, খাবার, গান, পুরষ্কার ও আজীবন সম্মাননায় সমৃদ্ধ হয় এবারের আয়োজন। উদ্বোধনের দিন ২৫ অক্টোবর বিকেলে আসেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। আড়ংয়ের যাত্রা শুরু এবং ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে মানুষের ভালবাসায় এগিয়ে গেছে সেই গল্পই উপস্থিত সবার সামনে তুলে ধরেন তিনি-‘নারীদের আর্থিক সচ্ছলতার কথা মাথায় রেখে আড়ংয়ের যাত্রা শুরু হয়। গ্রামের মহিলাদের কর্ম সংস্থানের ক্ষেত্রে এখন প্রতিষ্ঠানটি অভাবনীয় সফলতা লাভ করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে আড়ংয়ের ক্রেতা সাধারণের জন্যে। তারা দেশীয় পোশাকের প্রতি তাদের ভালবাসা দেখিয়ে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। আর এ জন্যেই পরবর্তীতে আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আড়ং তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।’
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের সিনিয়র পরিচালক তামারা হাসান আবেদও উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান নূর বলেন- ‘আড়ং যেভাবে দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে তাতে শুধু ৪০ নয়, আড়ং টিকে থাকবে আর ৪০০ বছর। গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তন করেছে তারা।’ দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর জন্যে কাজ করায় এই সময় আড়ংকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তুমুল হাততালি, হই হুল্লোড় আর উল্লাসে মেতে এই সময় সংস্কৃতিমন্ত্রীর বক্তব্যে সমর্থন জানান মঞ্চের সামনে বসা সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আড়ংয়ের উৎপাদক ও দর্শকেরা। এই দিন সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশ থেকে তাদের ৬৫ হাজার উৎপাদকের মধ্যে ৬টি বিভাগে মোট ৪০ জনকে পুরস্কৃত করে। আজীবন সম্মাননা লাভ করেন ৬ জন। এই সময় লোকশিল্পী শাহজাহান মুনশি ও তার দলের লোকজ গানের পরিবেশনা পুরষ্কার প্রদানের বিরতিতে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লার গান ছিল প্রথম দিনের উৎসব আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ। একের পর এক রুনা লায়লার জনপ্রিয় সব গানের পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হয় প্রথম দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন। আড়ং উৎসবের তিন দিনের প্রতিদিনই ছিল নতুন নতুন চমকে ভরা। মানুষের উপস্থিতি এবং আগ্রহ বেড়েছে রোজই। সব বয়েসি মানুষ বিশেষ করে তরুণদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মত।
দ্বিতীয় দিনের আয়োজনকে ঘিরে তুলনামূলক বেশি উৎসাহ দেখা গেছে সবার মধ্যে। এর কারণ হলো ফ্যাশন শো। আড়ংয়ের ফ্যাশন শো মানেই অভিনব কিছু। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে তাই ফ্যাশন শো’ কে ঘিরে মানুষের বাড়তি উন্মাদনা দেখা যায়। সন্ধ্যার পরে সবাইকে চমক দেন তামারা আবেদ। মঞ্চে এসে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা এবং ভালবাসা জানিয়ে শুরু করেন আড়ংয়ের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড তাগা, তাগা ম্যান ও হার স্টোরি তৈরির নানা কথা। দপ করে মঞ্চের আলো নিভে যায়। চারিদিকে হঠাৎ অন্ধকার। মঞ্চের পেছনটা ঝাপসা- কে যেন আলো হাতে এগিয়ে আসে? ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হলে দেখা যায় পেছন থেকে স্পটলাইটের আলো নিয়ে হেঁটে আসে সুদর্শন এক যুবক। আসলে ওই যুবক একজন মডেল ।তার গায়ে টি-শার্ট। এই টি-শার্ট দেখলেই বোঝা যায়, তা আড়ংয়ের প্রথাগত নকশা থেকে ভিন্ন- কিছুটা ওয়েস্টার্ন ঘরানার।পশ্চিমা ধাঁচের এই পোশাকের সংগ্রহ তাগা ম্যানের। এছাড়াও একই সাথে জুতা, শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট, শেরওয়ানি কাটের পাঞ্জাবি ও নানা ধরনের ব্যাগের সংগ্রহ উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে। এর পরের সারিতে তাগার সংগ্রহ নারীদের জন্যে। এখানে তরুণীদের পালাজ্জো, টপ কামিজ, জ্যাকেট ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়।
এর পরে রুচিশীল নারীদের পোশাক হার স্টোরির অনবদ্য উপস্থাপনা। এরপরে দ্য ডান্স অব পিকক নামের দৃষ্টি নন্দন শো। এটি আড়ংয়ের ময়ূর মোটিভ নামে পরিচিত। ময়ূরের রং ও মোটিভে শাড়ি, কামিজ আর লং ড্রেসের পরিবেশনায় মুগ্ধ নারী পুরুষ সবাই। আর একেবারে শেষ পরিবেশনা ছিল পাঁচ মিশালি। বিয়ের গহনা, পোশাক, ব্যাগসহ নানাবিধ সংগ্রহে সমৃদ্ধ হয় এই কিউতে। নববধূর সাজে জামদানি সংগ্রহের পরিবেশনায় পিন পতন নিরব দর্শক। কাঁথার ফোঁড়ের নকশার মাধ্যমে শেষ হয় মডেলদের ক্যাট ওয়ার্ক। আড়ং ফ্যাশন শো এর কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ আর রূপসজ্জায় পারসোনা এবং কানিজ আলমাস খান। ফ্যাশন শো’র ফাঁকে ফাঁকে বিরতিতে দর্শক মাতে এলিটা করীমের গানে।
আড়ংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল মানিকগঞ্জ থেকে। সালটা ১৯৭৮। সেই বছর গ্রামের গরীবের মেয়েদের ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠান আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। রেশম পোকার গুটি থেকে সুতা সংগ্রহ করে সিল্কের কাপড় বানানোর কৌশল শেখানো হয় প্রশিক্ষণে। তাদের তৈরি পণ্য তৈরি করে ঢাকার বিভিন্ন দোকানে প্রথমে বিক্রি করা হতো। কিন্তু এই কাজে মহিলাদের টাকা পেতে অনেক বিলম্ব হতো। তাই আয়শা আবেদ ফাউন্ডেশন নিজেই ঢাকায় পণ্য বিক্রি শুরু করে। ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মাথায় ধামন্ডির মিরপুর রোডে উদ্বোধন হয় আড়ংয়ের প্রথম আউটলেট। এই কাজের পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর সহধর্মিণী আয়েশা আবেদ আর মাথা চেন। সেই থেকে চলছে।
এরপরে আর আড়ংকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পণ্যের গুণগত মান, দাম এবং সৃজনশীলতা দিয়ে আড়ং জয় করে নেয় এই দেশের ফ্যাশন প্রিয় মানুষের মন। এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক বাড়তে থাকে আড়ংয়ের আউটলেট। শুধু ঢাকায় নয়। আড়ংয়ের পণ্যের চাহিদা তৈরি হয় ঢাকার বাইরেও। এ জন্যে ঢাকার বাইরেও এর শাখা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিজনেস ভলিউম বাড়তে বাড়তে বর্তমান এর আউটলেট সংখ্যা ২১টি। ঢাকায় ১৩টি আর চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে রয়েছে আড়ংয়ের শাখা। তাই এবারের আড়ং উৎসবে ঢাকার বাইরে থেকেও অসংখ্য মানুষ অংশ নেন। প্রতিদিন উৎসব সকাল ১১ টা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। পুরো আয়োজনকে ঘিরে স্টেডিয়ামে তৈরি করা হয় ১১টি বিশেষ স্টল। এই স্টলগুলোর মাধ্যমে ১১ রকমের পণ্য প্রদর্শিত হয় দর্শকদের জন্যে। ব্লক প্রিন্ট, মৃৎশিল্প, বাঁশের আসবাব, জামদানি তৈরি, রিকশা চিত্র আঁকা, কাঠ খোদাই নকশা, গয়নার নকশা, নকশি কাঁথার ফোঁড়, কাপড়ে প্রাকৃতিক রঙের নকশা, রেশম সুতা তৈরির বিভিন্ন পর্যায় ইত্যাদি। এই আয়োজনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিল ছিল- দর্শকদের জন্য আয়োজন করা হয় নানা রকম কর্মশালার। এই কর্মশালায় হাতে কলমে শেখানো হয় ব্লক প্রিন্ট, কাঁথার ফোঁড়, গয়না তৈরি, পোশাকে প্রকৃতির রঙের ডাইসহ নানা বিষয়। দর্শনার্থী এবং সবার জন্যে বাহারি স্বাদের খাবারের দোকান, শিশুদের বিনোদন কর্নার, পারসোনা, আইপিডিসির আলাদা স্টল ছিল মাঠের নানা প্রান্তে। আরও ছিল ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আড়ংয়ের সকল ফটোশুটের ছবি। এবারের উৎসব আয়োজন নিয়ে আড়ংয়ের প্রধান পরিচলন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘ আড়ংয়ের ৪০ বছরের পথচলা আমাদের কনজ্যুমারদের ভালবাসায় ধন্য। তাদের ভালবাসা না পেলে এতোটা পথ অতিক্রম করা সম্ভব হতো। প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, আমরাই সেরা। গ্রাহকদের রুচি, চাহিদা আর উৎসবের কথা মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। এই উৎসবে সবাইকে আমরা দেখাতে চেয়েছি কিভাবে আড়ং তাদের পণ্য তৈরি করে’।শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। তিন দিনের আড়ং উৎসবের শেষ ক্ষণটা হয়ে ওঠে আরও রঙিন। কারণ তখন মঞ্চে উঠেছেন নগর বাউল জেমস। পুরো স্টেডিয়াম থই থই করছে দর্শকে। কোথাও তিল ধারণেই ঠাঁই নাই। দরাজ কণ্ঠে জেমসের একের পর পরিবেশনার সাথে হাজারো দর্শকের কোরাস রাতের নীরবতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে নাগরিক ক্যানভাসে। জেমস এর সাথে জলের গান, নেমেসিস ও মিনারের গানে শত কণ্ঠের উল্লাসে আড়ংয়ের ৪০ বছর উৎসবে যোগ হয় প্রাণের স্পন্দন।