তুই ক্ষমা করে দিস মা! ২০১০ সালের আজকের দিনে আমাদের পরিবারের অনেক ভালোবাসা আর আদরের কন্যা কান্তা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। ছেড়ে চলে যায়, নাকি এই ঘুণে ধরা, বুলি সর্বস্ব সমাজ ব্যবস্থায় বড় অনাদরে, অবহেলায় চলে যেতে সে বাধ্য হয়েছে ? উওর আজো খুঁজে বেড়াই । যখন দেখি মানবতার দোহাইতে কেউ কেউ জনপ্রিয় হতে চাইছেন, শীর্ষে পৌছে গেছেন, তখন লজ্জা পাই তথাকথিত উচ্চশিক্ষার অহেতুক দৌড়, প্রচেষ্টা এবং প্রহসনমূলক আচরণ দেখে। প্রহসন বলছি এই কারণে, বাস্তবতার সঙ্গে তাদের তৎপরতার কোন মিল পাই না।
আজ কান্তাকে নিয়ে দুটি কথা বলব। উদ্দেশ্য, কান্তার মতন কোন অটিস্টিক ব্যক্তিকে যেন চিকিৎসা ব্যবস্থার অবহেলা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় না নিতে হয়।
কান্তা আমার বোনের মেয়ে। সে ছিল অটিস্টিক।২০১০ সালের ২২মে কান্তা হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। মায়ের একক কষ্ট, সেবায় কান্তা বেড়ে উঠতে থাকে। কারণ, কান্তার বাবা আমার দুলাভাই মরহুম মেজর কামাল আহমেদ খান ১৯৮৩ সালের ২৪ এপ্রিল একটি ঘূর্ণিঝড়ে বিধস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে যেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। একই জীপে একজন বয়স্ক মেজর জেনারেল, একজন সুবেদার নায়েক, একজন ড্রাইভার ছিলেন। হাটু জলে জীপ উল্টে সবাই বাঁচলেন, কান্তার বাবা ছাড়া। ফলে কান্তার মা’কে কঠিন সময় পার করতে হয়েছ প্রতিটি মুহূর্তে। কান্তা অসুস্থ্য হলে আমরা ভাইবোনেরা তাই অস্থির হই।
বাইরে বেরুতে অনভ্যস্ত, অনাগ্রহী কান্তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। মহল্লার এক ফার্মেসীতে পাওয়া গেল ডাক্তার। হাতজোড় করে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলাম কান্তাকে একটু দেখে আসবার জন্য। উনি কখনো কারোর বাসায় যান না, তথাপি রাজী হলেন। কান্তাকে দেখলেন। ঔষধ দিলেন। রক্ত, ইউরিন পরীক্ষা করতে দিলেন। ভিজিট নিতে চাইলেন না। বোন জোর করে দিলেন।
২৩ মে অবস্থার উন্নতি না হলে কান্তাকে দুপুরের দিকে হাসপাতালে নেবার সিদ্ধান্ত হল। বাবার মৃত্যুর পর যে কান্তা এ্যাম্বুলেন্স ও ডাক্তার দেখে ভয় পেত, কেঁদে উঠত, সেই কান্তা খুব সহজে, স্বাভাবিকভাবে দেরি না করে এ্যাম্বুলেন্সে চড়ে বসল। হয়ত সে বুঝেছিল, বাঁচতে হলে তাকে এ্যাম্বুলেন্সে বসতে হবে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ধানমন্ডির একটি প্রাসাদসম হাসপাতালে নেয়া হল কান্তাকে। ইমার্জেন্সির চেয়ারে নয়, কান্তা বসে পড়ে মেঝেতে। কোথায় তার কষ্ট, যন্ত্রণা সেটা কান্তা বলতে পারছে না। অস্থিরভাবে শুধু আম্মু আম্মু করছে, কাঁদছে। আর মাঝেমধ্যে নির্লিপ্তভাবে, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় মানুষগুলোকে। অবাক হলাম, কান্তা অটিস্টিক জেনে তাকে চিকিৎসা দিতে অপারগ হলেন হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক । বললেন, মানসিক হাসপাতালে নিতে। প্রচণ্ড প্রতিবাদের দাবিতে আমরা বললাম, মন নয়, ওর শারীরিক অবস্থা দেখুন। শারীরিক চিকিৎসা দিন !
মানবসেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হয়েও, তারা প্রকৃত মানবচিকিৎসক হতে পারেননি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক যুদ্ধে পারলাম না কান্তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়াতে সেই হাসপাতালে। অতপর সবাই কান্তাকে নিয়ে ছুটলাম পান্থপথের আকাশচুম্বী অভিজাত হাসপাতালে।
ততক্ষণে কষ্টের ভারে কান্তা নুইয়ে পড়েছে। ১০ তলার লিফট থেকে বের হতে সে শুয়ে পড়ে হাসপাতালের করিডোরে। কান্তা তার বুবুর কোলে মাথা রেখে শান্ত হতে থাকে ধীরে ধীরে। কাজিনরা জাপটে ধরে আছে তাদের দিদিকে। সকলের চোখ তখন জলে ঝাপসা হতে শুরু করেছে। হাসপাতালের কেউ বেড নিয়ে এগিয়ে আসে না ওকে তুলে নিতে। কারণ, কান্তা অটিস্টিক। আমি, আমার ভাই, বোন প্রচণ্ড ক্ষোভে, অপমানে জ্বলছি। উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া কান্তার চিকিৎসা দেয়া এখানে সম্ভব নয়।
কোথায় সেই উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ? অটিস্টিক বলে সে চিকিৎসা পাবে না, এমন হাসপাতালের দরকার কী তাহলে ? বাধ্য হয়ে পারিবারিক আর নিজেদের পরিচয় দিতে বাধ্য হলাম। যা আমরা চাইনি কখনোই।
একজন সিনিয়র চিকিৎসক আমাদের ব্যাকুলতা আর তাঁর আর্দশে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ফোনে একজনকে বললেন, আমি একজন চিকিৎসক, আমার প্রধান কাজ হল রুগীকে চিকিৎসা সেবা দেয়া। সেই চিকিৎসকের নির্দেশে হাসপাতালের করিডোরে প্রায় দুই ঘন্টা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা কান্তাকে বেডে তোলা হল। অক্সিজেন, স্যালাইন, ইনজেকশন, বুকে পাম্প… আরো কত কী করা শুরু হল।
কিন্তু আমাদের কান্তা আর ফিরে এলো না। চিকিৎসা সেবার মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই সব শেষ হল। বোনটি চিৎকার করে উঠল, বিছানায় আমার মেয়ে নেই কেনো! বোন ঠিকই দেখেছিল, কান্তা চলে গেছে মাকে ছেড়ে, আমাদেরকে ছেড়ে।
এই কষ্টের কথা আমি বহু জায়গাতেই বলেছি। আজো বলি। কালও বলব। আমার বলাতে যদি এসব হাসপাতালের ইট, বালি খসে খসে এদের মানবতার মুখোশ খসে পড়ত, শান্তি পেতাম।
তুই মাফ করে দিস মা! আমি জানি তুই অনেক ভালো আছিস মা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)