আশির দশকে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে দাঁড়ানো নেরি পাম্পিডো এবং সার্জিও গয়কোচিয়া নিশ্চয় আমাদের স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে অভিমানী চেহারার ধীর স্থির ঠাণ্ডা মেজাজের গয়কোচিয়া এখনও আর্জেন্টিনা ভক্তদের হ্নদয়ে ছবির মতো আটকে আছে। ৯০ এর বিশ্বকাপে গয়কোচিয়া চীনের প্রাচীরে সদৃশ ছিলেন। তাকে ভেদ করা অতো সহজ ছিল না।
৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গয়কোচিয়ার বারপোস্ট আগলানো আর প্রতিপক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়া ছিল বড় এক বিনোদন। বিশেষ করে পেনাল্টি শুট আউট ফিরিয়ে দিয়ে তিনি নতুন এক আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। স্মতর্ব্য যে, অসাধারণ সব পেনাল্টি শুট ঠেকিয়ে দেওয়ার কারণেই সেবার ম্যারাডোনার দল ফাইনালে উঠেছিল। ১৯৯০ সালের ৩০ জুনের কথা মনে করা যাক। সেদিন কোয়ার্টার ফাইনালের খেলায় আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল যুগোশ্লোভিয়া। টাইব্রেকারে যুগোশ্লোভিয়াকে ৩-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। সেই জয়ে মূল নায়ক ছিলেন গোলরক্ষক গয়কোচিয়া।
এরপর ৪ জুলাই সেমিফাইনালে ইতালির সাথে ম্যাচও গড়ায় টাইব্রেকারে। গোলরক্ষক গয়কোচিয়ার প্রতুৎপন্নতায় এ ম্যাচে ৪-৩ গোলে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা। সে সময় খুশির জোয়ারে ভেসেছিলেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা। গয়কোচিয়া আর্জেন্টিনার কোটি কোটি ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলেন সহসাই। গয়কোচিয়ার বিদায়ের পর আর্জেন্টিনার কোনো গোলরক্ষকই যে আর গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে তেমন নির্ভরতার পরিচয় দিতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। বরং গোলপোস্ট নিয়ে আর্জেন্টিনার ভক্তদের আক্ষেপ থেকেই গেছে। রেকর্ডপত্র খুঁজলে দেখা যাবে শুধুমাত্র গোলরক্ষকের কারণেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের অশ্রুসিক্ত হয়ে মাঠ ত্যাগ করতে হয়েছে।
মাঝে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে কিছুটা নির্ভরতা তৈরি করেছিলেন সার্জিও রোমেরিও। এরপর সমসাময়িকালে ফ্রাংকো আরমানি, নাহুয়েল গুজম্যান, উইলি ক্যাবেলেরো কেউ-ই তেমন তারকাচিত পারফরমেন্স উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু গয়কোচিয়ার ছায়া নিয়ে বোধ হয় এসেছেন আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের নতুন প্রহরী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
কোপা কাপের সেমিফাইনালে তাঁর অসাধারণ সেইভের কারণেই আর্জেন্টিনাকে আর নতুন করে অশ্রু সিক্ত হতে হয়নি। ৭ জুন কোপার সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। ম্যাচে আর্জেন্টিনা শুরুতে লিড নিলেও কলম্বিয়ার ধারালো আক্রমণে খেলায় সমতা ফিরে আসে। শেষে ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আর্জেন্টিনা শিবির কিছুটা অশনি সংকেত কড়া নাড়ছিলো। কিন্ত না, গোলরক্ষক মার্টিনেজ তিন তিনটি শুট সেভ করেন নান্দনিক ভঙ্গিমায়, অসাধারণ ডাইভে। শেষে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা।
কলম্বিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টনার জয়ের গল্পের নায়ক নিঃসন্দেহে গোলরক্ষক মার্টিনেজ। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন অচেনা, অর্বাচিন বা মুসাফির। এই প্রথম আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালনি তার জন্য অবারিত সুযোগ উন্মুক্ত করেছেন। অথচ ধারের (লোন) খেলোয়াড় হিসেবেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে মার্টিনেজের বছরের পর বছর সময় কেটে গেছে। কিন্তু না এখন তিনি বিশ্বময় পরিচিত হয়ে উঠেছেন। কলম্বিয়ার সাথে তাঁর অসাধারণ পারফরমেন্সের কারণে অনেকেই তাই সেই পুরনো স্মৃতি, মানে গয়কোচিয়া কালের স্মৃতিতে অবগাহন না করে পারেননি। ফুটবল বিশেষজ্ঞ আর আর্জেন্টাইন ভক্তরা মনে করছেন এতদিন পর আর্জেন্টিনা পায়ের নিচে অন্তত একখন্ড শক্ত মাটি পেয়েছে। কোপাকাপে এসেই সেই প্রমাণটা রাখতে পেরেছেন গোলরক্ষক মার্টিনেজ। আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়ে এবারই প্রথম খেলছেন মার্টিনেজ।
এর আগে জাতীয় দলে দু এক দফা ডাক পেলেও মাঠে নামতে পারেননি। অতিরিক্ত গোলরক্ষক হিসেবে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছে। কোপাকাপের আয়োজনে ৩ জুন চিলির বিপক্ষে তার প্রথম অভিষেক ঘটে। প্রথম ম্যাচে অবশ্য অপরাজেয় থাকতে পারেননি তিনি। এই ড্র ম্যাচে মার্টিনেজকে ৩৬ মিনিটে পরাভূত করে চিলির সানচেজ। এরপর প্রতিটি ম্যাচেই মার্টিনেজকে দেখা গেছে আস্থা ও দৃঢ়তার সাথে খেলতে। এ পর্যন্ত তিনি মোট ছয়টি ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু সেমিফাইনালে এসে মার্টিনেজ পেনাল্টি বক্সের আঠারো গজে নিজেকে অন্যভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
মার্টিনেজের জন্ম বুয়েন্স আয়ার্সের মার ডেল প্লাটাতে ৯২ সালের ২ সেপ্টেম্বরে। তবে মোটেও সোনার চামচ মুখে নিয়ে নয়, জন্ম হয়েছিল গরিব পরিবারে। যে পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। মার্টিনেজ নিজ চোখে দেখেছেন তার বাবা আলবার্ট বিভিন্ন বিল শোধ করতে না পেরে কাঁদছেন। অনেক রাতেই তাদের টেবিলে খাবার থাকতো না। এ কারণেই মার্টিনেজ নিজ পরিবারের ভাগ্য বদলের শপথ নেন ছোটবেলা থেকেই। মার্টিনেজের ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা হয় আর্জেন্টিনার পেশাদার ফুটবল দল অ্যাটলেটিকা ইনডিপেনডিন্টের হয়ে। এরপর তিনি ২০১১ সালে ইংল্যান্ডে এসে যোগ দেন আর্সেনালে। কিন্তু ভাষাগত (ইংরেজি একটুও না জানা) সমস্যা তার চলার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্যেও যেনো গিঁট পড়ে। মাঠে নামার সুযোগ আর আসে না।
তবে এরমধ্যে বিভিন্ন ক্লাবে খেলেন ধার করা গোলরক্ষক হিসেবে। পেশাদারী ফুটবলে মার্টিনেজের মাঠে অভিষেক হয় ১২ সালের ৫ মে অক্সফোর্ড ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে। অক্সফোর্ড ইউনাইটেড আর্সেনাল থেকে তাকে ধারে (লোন) নেন। অবশ্য ২০১৯ সালে ভাগ্য কিছুটা খুলে মার্টিনেজের। আর্সেনালের হয়ে ন্যাশনাল কাপে খেলার সুযোগ পান। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গত বছর মার্টিনেজ বিশ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে যোগ দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের এস্টনভিলাতে। এই ক্লাবের হয়ে মাঠে তাঁর অভিষেক ঘটে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। প্রথম ম্যাচ সেফিল্ড ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলতে নেমেই গোলপোস্টে চমক দেখান। এ ম্যাচে তিনি একটি পেনাল্টি রুখে দেন। এস্টনভিলার হয়ে এ পর্যন্ত মোট ৩৮টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। প্রথম সেশনে এস্টনভিলার সমর্থকদের ভোটে প্লেয়ার অফ দ্য সেশনও হয়েছেন।
একজন দক্ষ গোলরক্ষকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পাওয়ার, মুভমেন্ট, স্কিল, ব্যালেন্স, কিক, ডাইভ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মার্টিনেজের মধ্যে এসব গুণাবলী বিদ্যমান। আর্জেন্টিনা তাই তাকে ভরসা করতে পারে। তাকে নিয়ে আর্জেন্টিনা নতুন স্বপ্নের পথ ধরে এগুতেই পারে। তবে সেই স্বপ্নের পথে সামনে বড় লড়াই কোপা কাপের ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়া। এর আগে কখনই মার্টিনেজ ব্রাজিলের মুখোমুখি হননি। তাই এই লড়াই-এর চাপ তাপও মারাত্বক। এই লড়াই-এ মার্টিনেজ জিতলে তিনি গয়কোচিয়ার পাশে নিজের নামটি আরো ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। আর আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে তিনি হয়ে উঠবেন আরও প্রেমময়, আরও অনন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)