লর্ডস থেকে: ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা সংস্থা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) পরিচালনা করে বিখ্যাত স্টেডিয়াম লর্ডস। যার পরতে পরতে আভিজাত্যের নানা নিদর্শন আর রীতি। যার মধ্যে অন্যতম এমসিসি প্যাভিলিয়ন। হাজারখানেক ক্রিকেট বোদ্ধা এখানে বসে একসঙ্গে খেলা দেখতে পারেন।
ক্রিকেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে এমসিসির চেয়ে ভালোভাবে আর কেউ ধারণ করেনি। ২০৫ বছর পুরনো এই স্টেডিয়ামের প্যাভিলিয়নে বসতে পারেন কেবল এমসিসির সদস্যরাই। ক্রিকেটারদের ড্রেসিংরুম ও ব্যালকনি ছাড়া তিনতলা ভবনের সম্মুখভাগের পুরোটাই বরাদ্দ থাকে তাদের জন্য।
বিশ্বকাপের চার সেমিফাইনালিস্ট নির্ধারণ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে এমসিসি সদস্যরা মাঠে আসবেন কিনা সেটি নিয়ে ছিল সংশয়। অনেকটা ফাঁকা থাকলে যে ইজ্জত যাবে! ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব যাদের তারাই যদি মাঠে না আসেন তাহলে মান যাওয়া তো স্বাভাবিকই। তবে লর্ডসে শ’পাঁচেক এমসিসি সদস্য এসেছেন বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে।
বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে এখানে শেষ ম্যাচ এটি। এমসিসি সদস্যরা বসেছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফলে ফাঁকা জায়গা খুব বেশি চোখে পড়ছে না। শ’খানেক স্কুল শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ জানানোয় প্যাভিলিয়ন ভরাটই লাগছে ক্যাপসুল আকৃতির প্রেসবক্স থেকে।
বোলিং প্রান্ত, ব্যাটিং প্রান্তের দুটি ভবনই বেশ নীরব। তবে আশপাশের সাধারণ দর্শকদের গ্যালারিতে চলছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমর্থকদের হৈ-হুল্লোর। সাংবাদিকরা পেশাদার। যে কারণে তারা চুপ।
ইংলিশ সমর্থকরা নীরব থেকেই ক্রিকেট উপভোগ করতে পছন্দ করেন। তবে ক্রিকেটারদের সাফল্যকে উৎসাহ দিতে তারা বেশ উদার। ইমাম-উল-হক সেঞ্চুরি, বাবর আজম ৯৬ করে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে প্যাভিলিয়নে সবাই দাঁড়িয়ে করতালিতে অভিনন্দিত করলেন। ৫ উইকেট নিয়ে অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো মোস্তাফিজুর রহমানের বেলায়ও দেখা গেল একই দৃশ্য। প্রতি বলে কিংবা ওভারে তারা উদযাপন করেন না। ল্যান্ডমার্কে পৌঁছালে তাদের করতালি যেন আর থামেই না! এটা এখানকার অঘোষিত রীতিই হয়ে গেছে।
ব্যালকনি থেকে বের হয়ে যে পথ ধরে ক্রিকেটাররা মাঠে ঢোকেন, সেটির পাশেই লর্ডসের প্যাভিলিয়ন। এ প্যাভিলিয়নে সাধারণ দর্শকদের প্রবেশাধিকার নেই। কেবল এমসিসির সদস্যরাই এখানে বসে ম্যাচ দেখার সুযোগ পান।
লর্ডসে ম্যাচ হলে প্যাভিলিয়নে সব সময়ই সরব উপস্থিতি থাকে এমসিসির সদস্যদের। নিরুত্তাপ ম্যাচেও শ’পাঁচেক ক্রিকেটবোদ্ধা এসে জানান দিয়ে গেলেন, বৈশ্বিক ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হলেও তাদের মাঠে আসতে হয়।
২০১৭ সালের নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে মাঠের বাকি অংশের দর্শকসংখ্যা ও প্যাভিলিয়নে উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যা নিয়ে অপ্রীতিকর তুলনার মুখে পড়তে হয়েছিল এমসিসিকে। আরও একবার যেন বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে পড়তে না হয়, সেজন্য আগেভাগেই ক্লাবটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যারা (এমসিসি সদস্য) এখনো টিকিট কেনেননি, তাদের প্রত্যেককে মেইল করেছে এমসিসি কর্তৃপক্ষ। সদস্যদের উদ্দেশে করে একটি কলামও লিখেছেন এমসিসির সেক্রেটারি ও প্রধান নির্বাহী গাই ল্যাভেন্ডার।
বর্তমান যে প্যাভিলিয়নটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি ১৮৯০ সালে উন্মুক্ত করা হয়। নতুন করে নির্মাণ করতে প্রাচীন প্যাভিলিয়নটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে নারীদের প্রবেশাধিকার শুরু হয়। তার আগে প্যাভিলিয়নে বসতে পারতেন কেবল পুরুষরাই। ১৯৮৬ সালে ভারতীয় নারী দলের টেস্ট অধিনায়ক ডায়ানা এডুলজিকে ম্যাচের সময় বসতে দেয়া হয়নি। ১৯৯৯ সালের আগে এমসিসি প্যাভিলিয়নে বসতে পারা একমাত্র নারী রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
প্যাভিলিয়নের উপর দিয়ে বল মেরে বাইরে পাঠানো একমাত্র ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়ার আলবার্ট ট্রট। কাউন্টি ক্রিকেটে ১৮৮৯ সালের পর যে ঘটনা দ্বিতীয়টি আর ঘটেনি। তবে ২০১৯ সালে সমারসেট কাউন্টি ক্লাবের অধিনায়ক মার্কাস ট্রেসকোথিককে এক মিলিয়ন পাউন্ড উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল প্যাভিলিয়নের তিন তলায় বল আছড়ে ফেলায়।
এমসিসি সদস্যরা খেলা দেখতে প্যাভিলিয়নে আসেন নির্ধারিত ড্রেস কোড মেনে। কোট, টাই থাকতেই হবে। ভেতরের শার্ট হতে হবে সাদা। বসার জন্য চেয়ার নেই। আছে রংয়ের বেঞ্চ। উল্টো পাশের কাঁচে ঘেরা প্রেসবক্স থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে মধ্যবয়সী ভদ্রলোকদের পরনে সাদা শার্ট, গলায় বাধা টাই। লর্ডস একমাত্র ভেন্যু যার ২০০ বছর পূর্তি পালিত হয়েছে সেটি চার বছর গড়িয়ে গেছে।
এতো গেল একটা ভবনের কিছুটা বর্ণনা। এখানে আছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, স্মৃতিস্তভ। ক্লাবের আলাদা মাঠ। লর্ডস কেনো লর্ডস তার ধারণা হয়ত একটু পাওয়া গেছে।