২০১৪ বিশ্বকাপে জর্জিও কিয়েল্লিনির কাঁধে কামড় বসিয়ে চার মাসের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ অবস্থায় লিভারপুল থেকে বার্সেলোনায় যোগ দেন লুইস সুয়ারেজ। তখন বার্সা ভক্তদের মনে খানিকটা শঙ্কা ছিল, ছিল চাপা অসন্তোষও। কথায় কথায় অন্যকে কামড় বসানো এক খেলোয়াড়কে কেনো দলে টানা, বিশেষ করে যখন স্কোয়াডে মেসি-নেইমারের মতো তারকা ফরোয়ার্ডরা আছেন।
বার্সা ভক্তদের আশঙ্কা মোটেও অমূলক ছিল না। অতীতে জাতীয় দল-ক্লাবগুলোতে একের পর এক ‘অমানবিক’ কাণ্ড ঘটিয়ে আসা সুয়ারেজ ন্যু ক্যাম্পেও যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অবতারণা করবেন না কোনো গ্যারান্টি তো ছিল না। এমন পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, বাধ্য হয়ে সুয়ারেজের চুক্তির মধ্য একটা গোপন ক্লজ সেসময় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বার্সার পক্ষ থেকে উরুগুয়ে তারকাকে জানিয়ে দেয়া হয়, যদি অখেলোয়াড়সূলভ আচরণের কারণে ভবিষ্যতে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে বেতন থেকে কেটে নেয়া হবে মোটা অংকের অর্থ!
বার্সার ভাবনা ছিল বেতন হারানোর ভয় থেকেই মাঠে নিজেকে শুধরে নেবেন সুয়ারেজ। একইসঙ্গে ছিল আরেকটা ভয়ও। বিশ্বের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি, ক্লাবের ভবিষ্যৎ নেইমারের সঙ্গে কতটা মিলতে পারবেন সুয়ারেজ। তিনজনকে একসঙ্গে খেলানো যাবে কিনা, নাকি সাউথ আমেরিকান দ্বন্দ্বের আঁচ বার্সার আক্রমণভাগকে তছনছ করে ছাড়বে, সবকিছু মিলিয়েও উরুগুয়ের বিতর্কিত ফরোয়ার্ডকে বেশ চড়া দামে কিনে এক জুয়াই খেলেছিল বার্সা।
নাহ্, শেষ পর্যন্ত বার্সা জুয়াতে হারেনি। বরং উপযোগিতা শেষ হওয়ায় একপ্রকার জোর করে সুয়ারেজকে তাড়িয়ে দিল ক্লাবটি। বুড়ো হয়ে গেছেন, আগের মতো সর্বস্ব দিতে পারেন না, তাই রোনাল্ড কোম্যান কোচ হয়ে এসে আগে সুয়ারেজকে বার্সেলোনা ছাড়ার ব্যবস্থা করেছেন। চিন্তাতে আনেননি চোট থাকার পরও ৩৬ ম্যাচে এই বুড়ো সুয়ারেজই গত মৌসুমে ২১ গোল করেছেন, মাত্র ছয় মৌসুমে ১৯৮ গোল করে হয়েছেন বার্সার ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার!
অভিমান আর চোখে জল নিয়ে বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে বার্সাকে বিদায় জানিয়েছেন সুয়ারেজ। যোগ দিয়েছেন বার্সার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। ন্যু ক্যাম্পে রেখে এসেছেন লিওনেল মেসি নামের নিঃসঙ্গ এক যোদ্ধাকে। সুয়ারেজের বিদায়ে নদীর পাড়ে ধসে পড়ার অপেক্ষায় ভবনের মতো ‘এমএসএন’ নামের এক কিংবদন্তি ত্রয়ীর ইতিহাসকে একাই আগলে রাখার দায়িত্ব সামলাতে হবে এখন মেসিকে।
অথচ সুয়ারেজ যোগ দেয়ার পরপরই যে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বার্সার আক্রমণভাগ, সেটা শুরুতে বোঝা যায়নি। মৌসুমের শুরুতে মেসি চোটে পড়লেন, নতুন কোচ লুইস এনরিকের সঙ্গে আর্জেন্টাইন তারকার মনোমালিন্যের খবরও সামনে এলো। তার চোটের কারণে দলের আক্রমণভাগ সামলানোর দায়িত্ব পড়ল নেইমার ও সুয়ারেজের কাঁধে। বার্সা হোঁচট খেলো প্রথমদিককার ম্যাচগুলোতে।
ধাক্কা খেয়েই যেন মাথা খুলে গেলো নেইমার-সুয়ারেজের। তারপর থেকে দলকে এমনভাবে সামনে এগিয়ে নিতে লাগলেন, মেসি যে নেই সেটা টেরই পাওয়া গেল না। এর মাঝে আবার সুস্থ হয়ে মেসিও দলে যোগ দিলেন। জন্ম হল এক ইতিহাসের, এক কিংবদন্তি ত্রয়ীর। তিন ফুটবলারের আদ্যাক্ষর দিয়ে তৈরি ‘এমএসএন’ ত্রয়ীর মতো এমন আক্রমণভাগ শুধু বার্সাই নয়, ফুটবল ইতিহাসের আর কোনো ক্লাব পাবে কিনা তা নিয়ে আছে প্রশ্ন!
কি করেনি এমএসএন ত্রয়ী? সাউথ আমেরিকান ফুটবলের তিন জায়ান্টের তিন সেরা তারকা এক জোট হয়ে প্রথম মৌসুমেই বার্সাকে জিতিয়েছে দ্বিতীয় ট্রেবল। কেবল একটির জন্য মৌসুমের সম্ভাব্য ছয় ট্রফি জেতার দ্বিতীয় কীর্তি গড়া হয়নি কাতালান জায়ান্টদের।
তিন মৌসুম একসঙ্গে খেলেছেন মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার, মোট ১১৩ ম্যাচ। এই কয় ম্যাচে তিনজনের ২৫৩ গোলই বলে দিচ্ছে প্রতিপক্ষের উপর কতটা আগ্রাসী ছিল এমএসএন। পরিসংখ্যান বলছে এমএসএন একসঙ্গে খেললে বার্সার জয়ের রেকর্ডটা ছিল ৭৭ শতাংশ। আর তিনজনের একজন যদি ম্যাচে না থাকতেন, গোলের হার এক লাফে ৭৩.৭ শতাংশে কমে যেত।
মাঠের মতো বাইরেও একজোট ছিলেন মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার। তিনজনের বন্ধুত্ব ফুল হয়ে ফুটতো মাঠে। এমনও হয়েছে, নিজে শট করলেই গোল পান, সেখানে বন্ধুকে দিয়ে গোল করিয়েছেন একজন। হয়তো সুয়ারেজ অফফর্মে আছেন, তাকে পেনাল্টি ছেড়ে দিয়েছেন মেসি, কিংবা পছন্দমতো জায়গায় ফ্রি-কিক পেলেও নেইমারের জন্য শট বরাদ্দ রেখে দিয়েছেন সুয়ারেজ।
তিনজনের বন্ধুত্বই আসলে পাল্টে দিয়েছিল একে-অন্যকে। বার্সায় থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের উপর শারীরিকভাবে চড়াও হয়েছেন সুয়ারেজ, এমন ঘটনা ঘটেনি একেবারে। আর নেইমারের সমস্যা ছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা। শুরুতে মেসি ও পরে সুয়ারেজের সান্নিধ্য পায়ের তলায় মাটি এনে দেয় ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের।
পাল্টে গিয়েছিলেন মেসি নিজেও। নেইমার-সুয়ারেজের সঙ্গে খেলেছেন, এমন প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল পেয়েছেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। প্রিয় দুই বন্ধুর কাছ থেকে বলের সঠিক যোগান পেয়ে মেসির গোলের হার ছিল ১০৪ শতাংশ! অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ম্যাচেই গোল করেছেন। ক্যারিয়ারের পঞ্চম ব্যালন ডি’অরটা সুয়ারেজ-নেইমার থাকা অবস্থায় শোকেসে তোলেন এলএম টেন।
সবকিছুরই যেমন শেষ আছে। এমএসএন ত্রয়ীর দাপট শেষ হয় ২০১৭ সালে, ২২২ মিলিয়নে নেইমারের পিএসজিতে পাড়ি জমানোর মধ্য দিয়ে। তার চলে যাওয়ার পরপরই শুরু বার্সায় ভাঙনের।
নেইমার চলে যাওয়ার পর তার শূন্যস্থান পূরণে দুহাতে টাকা ঢেলেছে বার্সা। লিভারপুল থেকে আনা হয়েছে ফিলিপে কৌতিনহোকে, বরুশিয়া থেকে এসেছেন উসমানে ডেম্বেলে। কাজ হয়নি। এমএসের এন হয়ে উঠতে পারেননি কেউই।
উল্টোদিকে পিএসজিতে গিয়ে অশান্তি শুরু হওয়ার পর আবারও বার্সায় ফিরতে চেয়েছিলেন নেইমার, প্রয়োজনে নিজের পকেটের টাকা ঢেলেও। কিন্তু বার্সা সভাপতি বার্তেমেউয়ের একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত আর উল্টোপাল্টা দলবদলে শেষ পর্যন্ত মেসি-সুয়ারেজের সঙ্গে পুনর্মিলন হয়নি নেইমারের।
নেইমারকে পাশে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মেসি। সবশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হবার পর ছাড়তে চেয়েছেন ক্লাবও। বার্সা তাকে ছাড়েনি, উল্টো ছেড়ে দিয়েছে সুয়ারেজকে। তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে আরেকটা এমএসএন ত্রয়ীর স্বপ্ন!
সে যাই হোক, বুকে কষ্ট নিয়ে ছাড়লেও বার্সা থেকে অনেক মধুর স্মৃতি নিয়ে মাদ্রিদে বসতি গেড়েছেন সুয়ারেজ। ক্লাবটির হয়ে প্রথম মৌসুমেই জিতেছেন চার ট্রফি, জিতেছেন গোল্ডেন বুটও। মেসির পর দুটি গোল্ডেন বুট জেতার কীর্তি কিন্তু তারই, সেটা বার্সার হয়েই। জিতেছেন কাঙ্ক্ষিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগও।
শেষ মৌসুমে যদিও বার্সাকে কিছু দিয়ে যেতে পারেননি, কেবল চোখের জল ছাড়া। যেভাবে বিদায় নিতে হয়েছে সেসময় অবশ্য কান্না ছাড়া দেয়ার কিছু ছিলও না। তবে বার্সার ইতিহাসের তৃতীয় গোল স্কোরের চোখের জল, কম কিছু নয়! সুয়ারেজের কান্না এরইমধ্যে ঠাঁই পেয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। মেসি-নেইমার আর তাকে নিয়ে বার্সার যে কিংবদন্তি জুটি, সেটা নিয়ে বার্সার সমর্থকরা গল্প করতে পারবে যুগের পর যুগ।