চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এবারের রমজান মাসে অপরাধ প্রবণতার কারণ অনুসন্ধান

এবারের রমজান মাসের আগমন অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় ভিন্নতর বার্তা বহন করছে যেটিকে সামাজিকভাবে ব্যতিক্রম ও অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার শামিল বলাটাই শোভনীয় মনে হয়। কেননা করোনার ভয়াবহ ও সংকটময় পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ববাসীর ন্যায় বাঙালি জাতির জীবনে একটি সংকটময় পরিস্থিতির আবির্ভাব তৈরি হয়েছে এবং আপদকালিন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদেশে সরকারের ঘোষণা মোতাবেক করোনার ভয়াবহতাকে প্রতিকারের জন্য কঠোর লকডাউন চলছে। লকডাউন কার্যকরভাবে কতটুকু মানা হচ্ছে কিংবা সাধারণ জনগণ মানতে পারছে কিনা সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার পূর্বে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় একশ্রেণীর মানুষের নিকট টিকে থাকাটাই বড় হয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকারে উপস্থাপন হচ্ছে। একদিকে জীবনের নিরাপত্তা অন্যদিকে জীবিকার অনুসন্ধান সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলছে।

কাজেই, অবস্থার প্রেক্ষিতে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন; এই রমজান মাসে অপরাধের বৈচিত্র্যতা দেখা যাবে এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে অপরাধ সংক্রান্ত ইস্যুতে আরো বেশি নজরদারি ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি এবং লকডাউনের ফলশ্রুতিতে একশ্রেণির মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে। সামাজিক, পেশাগত ও আর্থিক দূরবস্থার কারণে অনেকেই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে সামাজিক চুক্তি ও বিধি-নিষেধকে অবজ্ঞা করে স্ববিরোধী অপরাধ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। সুতরাং, অপরাধের নানাবিধ কারণকে বিশ্লেষণ করলে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের নিমিত্তে ব্যবস্থা নেয়াটা সহজতর হবে।

“জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল” কবি যথার্থই বলেছেন: জন্মের সাথে অপরাধের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। একজন ব্যক্তি সাধারণের ঘরে জন্মগ্রহণ করে তার কর্মের গুণে অসাধারণ খ্যাতি লাভ করতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে একজন বিখ্যাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কর্মের গুণে সাধারণের কাতারে নেমে আসতে পারে। তবে সাধারণভাবে প্রচলিত দৃষ্টিতে দেখা যায়, নিন্ম ঘরে জন্মগ্রহণ করা ছেলেমেয়েদের অপরাধী হিসেবে দেখা হয়ে থাকে যা স্বাভাবিকভাবে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ধারণা, উঁচু ঘরের ছেলেমেয়েরা কম অপরাধের সাথে জড়িত হয়। অন্যদিকে দেখা যায়, উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা কর্পোরেট ক্রাইম এবং ওয়াইট কালার ক্রাইম করেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সুতরাং জন্মগত বা পেশাগত কারণে কাউকেই অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা সমীচিন হবে না, কেননা হয়তবা রিপুর তাড়নায় অথবা অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে মানুষ অপরাধের সহিত জড়িত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ঘটনার সাপেক্ষে যাচাই বাছাই করে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করাই হবে যৌক্তিকতা।

অপরাধের কারণগুলোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে হলে কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করতে হয়। যেমন: জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বহুমুখী উপাদানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে কারণ নির্ণয় করা হয়। জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি সুপ্রাচীন হলেও বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের দিক থেকে এটি প্রথম প্রয়াস। এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হল: শারীরিক গড়নের উপর মানুষের আচরণ বহুলাংশে নির্ভরশীল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের আচরণের ও পরিবর্তন হয় এবং শারীরিক গঠন অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ শারীরিক গঠন অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কিন্তু বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ও উৎকর্ষতায় শারীরিক গঠনটি এখন আর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে না।

বিশেষ বিশেষ শারীরিক গঠন বিশেষ বিশেষ অপরাধের জন্য বিবেচিত হয়। নিরপরাধীর তুলনায় অপরাধীরা শারীরিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ, অস্বাভাবিক এবং কোন না কোন ভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ। মুখমণ্ডলের বিশেষ ধরনের গঠন ও বৈশিষ্ট্যের জন্য মানুষের অপরাধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। দাড়ি, চোখ, চিবুক, নাক ও মুখম-লের গঠনের অসামঞ্জস্যতার জন্য অনেকেই অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। মস্তক, খুলির আকার, গঠন কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে মানবচরিত্র নির্ধারিত হয়ে থাকে। অসামঞ্জস্য মুখমণ্ডল, বৃহদাকার এবং অতিবিকশিত চোয়াল, ত্রুটিপূর্ণ চোখ, অস্বাভাবিক কানের আকৃতি, বক্রাকৃতির নাক, পশমী চুল, দীর্ঘ বাহু এবং অস্বাভাবিক মস্তক থাকলে অনেক সময় মানুষ অপরাধী হয়ে উঠে। তাছাড়া অনেকেই জন্মগত, অভ্যাসগত, বিচারবুদ্ধিহীন এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।

মনস্তাত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্যক্তির অপরাধপ্রবণতার জন্য সামাজিকভাবে উদ্ভূত কিছু বিষয়ের উপাদানগুলোর উপর গুরুত্ব দিতে হয়। সামাজিক ভারসাম্য ভুলুণ্ঠিত হলে সমাজে অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সামাজিক কিছু কার্যকলাপের ভিত্তিতে মানুষের মন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। এমন কিছু উপাদান হল: ঈর্ষাপরায়ণতা, হীনমন্যতা, হতাশা, স্বার্থ এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং দুর্বল চিত্ত। একই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে সামাজিক ভারসাম্যহীনতার ভিত্তিতে সামাজিক শ্রেণীর উৎপত্তি হয় ঠিক তখনই এক দল অন্য দল বা গ্রুপের উপর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠে। একজন অন্যজনের যশ, প্রভাব, প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি দেখে পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে হানাহানি, ঝগড়া, ফ্যাসাদ এবং মাঝে মধ্যে বড় ধরনের অপরাধও সংঘটিত হয়ে থাকে। মানুষের দৈহিক ত্রুটি, অযোগ্যতা, অক্ষমতা ইত্যাদি অনেক সময় ইনফেরয়িটি কমপ্লেক্স সৃষ্টি করে থাকে। এ ধরনের শারীরিক অযোগ্যতার কারণে ঐ ব্যক্তিটি সমাজে অন্যের দ্বারা বিদ্রুপের স্বাীকার হয় যে বিষয়টি তাকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। কানা, বধির, কালা, বোবা, টেরা চোখ থাকা ইত্যাদি শারীরিকভাবে মানুষকে হীনমন্য করে তোলে। অন্যদিকে এ বিষয়গুলো থাকার কারণে অনেক ছেলে মেয়ের দ্বারা অপমানিত এবং লাঞ্জিত হয়ে থাকে এবং অপকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে।

প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, কাজকর্মে সফলতা না আসা, চাকরিতে যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও বেকার থাকা, কোন বিশেষ লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ চেষ্টা স্বত্তেও সাফল্য না আসা ইত্যাদি কারণে মানুষের মাঝে হতাশা গ্রাস করে। হতাশার ফলশ্রুতিতে হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিরা ধূমপান, মদ্যপান, আত্নহত্যা এবং খুন খারাপি করে থাকে। এর বড় উদাহরণ হল ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির অব্যবহিত নির্বাচনের পরে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছিল তার একটি অংশে বেকার যুবকের অংশগ্রহণ ছিল। সমাজে বাস করতে গিয়ে কয়েকটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিয়ম কানুন তৈরি করে থাকে। পরবর্তীতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তারই প্রেক্ষিতে নিজেদের চরিতার্থ অর্জনের জন্য এমন সব পন্থা অবলম্বন করে যা সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করে থাকে এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব তৈরি করে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অভাব দেখা যায় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান সেখানেই অন্তর্ঘাতী দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এছাড়াও হরতাল, অবরোধ, অবৈধ সমাবেশ, ডিপার্টমেন্টাল বিদ্রোহ ইত্যাদি কারণে আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা যায়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী এবং আইনভঙ্গকারী জনতার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়, টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষে ৪ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয় যার ফলশ্রুতিতে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে। ধর্ম এবং গোষ্ঠীগত কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টির হয়। ধর্মীয় মতবিরোধ, সামাজিক রেষারেষির কারণে এবং দ্বিপাক্ষিত মতপার্থক্য, বর্ণ বৈষম্য এবং জাতিগত কারণের জন্য ও অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে অনেক সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় অনেক সময় যেটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সহিংসতায়ও রূপ নেয়।

লকডাউনদুর্বল চিত্তের অধিকারী মানুষ সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষেরা দুর্বল চিত্তের অধিকারী হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত আবেগী এবং মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ মানুষেরা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম। নিজেদের উপরে হীনমন্যতার ধরুণ তারা অনেক সময় অপরাধের দিকে ধাবিত হয় এবং রাষ্ট্রকে অন্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা চালায়। পরিশেষে বলা যায়, রমজান মাসে করোনার সংকটকে কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে বিত্তশালীদের এগিয়ে এসে সাধ্যানুযায়ী কর্মজীবী মানুষদের সাহায্যার্থে কাজ করতে হবে, সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে করোনার সংকটকে মোকাবেলা করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)