এবারও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বঞ্চিত হলেন আশির দশকের অন্যতম সেরা তারকা ফুটবলার গাজীপুরের আজমত আলী। বিশ্বাস ছিল নানা রোগে বিধ্বস্ত জীবনের প্রান্ত বেলায় এসে তিনি শেষ মর্যাদাটুকু পাবেন। কিন্তু তালিকাতে নাম না থাকায় হতাশ হতে হয়েছে তাকে। বেশ কয়েকবার জাতীয় দলে নেতৃত্ব দেওয়া এই সাবেক ফুটবলার সব রীতি মেনেই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু তার আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। অথচ ফুটবলে তার অবদানের চেয়ে যাঁদের অবদান অনেক অনেক কম তারাও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
এ কথা সত্য, আশির দশকে রক্ষণভাগ সামলে বাংলাদেশের যে সব ডিফেন্ডার ফুটবল ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখতে সক্ষম হন তারে মধ্যে অন্যতম আজমত আলী। এই নামটা এখনও শুনলে ফুটবলমোদীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক জাদুকর স্টপারের প্রতিচ্ছবি। যাকে ভেদ করে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ডিবক্সে ঢুকে গোল করা ছিল সবচেয়ে দূরুহ কাজ। ফুটবলের স্বর্ণযুগে আজমত আলী এমনটিই ছিলেন। ফরোয়ার্ড জোনে তখন কত কত তারকা, ক্লাসিক ফুটবলার।
কিন্তু অনেকটাই গ্রামীণ গন্ধে ভরা আজমত ছিলেন রক্ষণভাগে অনড়-অটল আত্মবিশ্বাসী এক দুর্বার ফুটবলার। আশির দশকে ফুটবলের স্বর্ণযুগে ধারাভাষ্যকাররা মোলায়েম কণ্ঠে বলতেন আজমত ‘চীনের প্রাচীর’। আর গলি-ঘুপচির টং দোকানে আড্ডামারা ফুটবল প্রেমিকদের কাছে আজমত পরিচিত ছিলেন ‘বেড়া’ হিসেবে।
এই আলোচিত, তারকা স্টপার ব্যাক আজমত বহু আগেই ফুটবল ছেড়ে আড়ালে চলে গেছেন। সাবেক অনেক ফুটবলারই ফুটবল ছেড়ে অফিসিয়াল বা কোচ হিসেবেও মাঠের মায়া ধরে রাখলেও আজমত অনেকটাই নির্বাসনে। ফুটবলের সাথে খুব একটা আর সম্পর্ক রাখেননি। এ কারণেই আজমত নামটা এখনও ফুটবল প্রেমিকদের কাছে যতোটা সতেজ হয়ে আছে ঠিক তেমনি ফুটবল প্রেমিকদের স্মৃতিপট থেকে যেনো হারিয়ে গেছে তার চেহারা। তবে আজমত হারিয়ে যাননি, থাকেন গাজীপুরে নিজবাড়িতে। বয়স বেড়ে যাওয়ায় তেমন ঢাকায়ও আসা হয় না তার।
আশির দশকে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ আর জাতীয় দলের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন রক্ষণের এই ফুটবলার। বলতে দ্বিধা নেই মোহামেডান-আবাহনীতে বেশিসময় ধরে না খেলেও সেসময়কালে যে সব ফুটবলাররা তারকাখ্যাতি পেয়েছেন আজমত তারে মধ্যে অন্যতম। যদিও সত্তর দশকে ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগে আজমতের অভিষেক ছিল মোহামেডানের স্পোটিং ক্লাবের হয়ে তবে এখনও তিনি ট্রেডমার্ক ‘ব্রাার্সের আজমত’ হিসেবেই। ফুটবল জীবনের বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন ব্রাদার্স ক্লাবেই। শেষবিদায়টা ছিল এই ক্লাবের হয়েই।
সত্তর দশকে আজমতের ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলাটাও ছিল যেনো অন্যরে থেকে আলাদা। অনেকে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ছোট ক্লাব দিয়ে শুরু করলেও আজমত শুরুটাই করেন সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব দিয়ে। সেটা ১৯৭৭ সালের কথা। এর আগের বছর ৭৬ সালে গাজীপুরের বরমীতে মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের ফুটবলাররা একটি স্থানীয় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলতে যায়। নওসের, টিপু, মালা, মঞ্জু তখন মোহামেডানের টপ ফুটবলার। প্রতিপক্ষের লে স্টপার পজিশনে খেলেন আজমত।
মোহামেডানের তারকা ফুটবলারের বিরুদ্ধে আজমত একাই প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান। প্রথমার্ধ গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। ঐনিয়েই মোহামেডানের খেলোয়াড় আর অফিসিয়ালদের চোখে পড়েন আজমত। ঐ বছরই ফুটবলার মালা আজমতকে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের ফাইনাল ম্যাচ খেলানোর জন্য তার নিজের ক্লাব মুসলিম ইনস্টিটিউটের পক্ষে খেলার জন্য নিয়ে আসেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে শাজাহানপুরের বিরুদ্ধে এটিই ছিল আজমতের প্রথম ম্যাচ। এই ম্যাচে আজমতের খেলা দেখে মোহামেডানের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আমান চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেন আজমতকে দলভুক্ত করবেন।
পরের বছর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে লভুক্ত করে তাকে। প্রথম পর্বে না খেলতে পারলেও সুপার লীগে চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। তবে প্রথম ম্যাচে ব্রাদার্সের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান রাইট আউটে। পরের ম্যাচগুলোতে তিনি নিজস্ব পজিশন রাইট ব্যাকে চলে আসেন। অবশ্য মোহামেডান ছেড়ে পরের বছরই আজমত লবল করে চলে আসেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। সে সময়কার ক্যাপ্টের সেলিমের অনুরোধে ৭৮-৭৯ এই দুই বছর ব্রাদার্স ক্লাবে খেলেন।
কিন্তু পরের বছর (১৯৮০) আবার দলবল করে যোগ দেন বিজেএমসি ক্লাবে। এ সময় বিজেএমসির মোকসেদ, রকিব, আইনুলের পাশে দাঁড়িয়ে স্টপার ব্যাক হিসেবে নিয়মিত খেলা শুরু করেন। বিজেএমসির হয়ে দারুণ পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেন। একবছর বিজেএমসিতে খেলে আবার ব্রাদার্স-এ ফিরে যান। এ সময় ‘ব্রাদার্সের আজমত’ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ব্রাদার্সে খেলে ফের যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ৮৩-৮৪ এ বছর মোহামেডানেই থাকেন। ৮৫ সালে দলবদল করে চলে আসেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে।
টানা ৯০ সাল পর্যন্ত ব্রাদার্সের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে থাকেন। ততদিনে পারফরম্যান্স পড়তির দিকে চলে আসে। ৯২ সালে আবার ব্রাদার্সে ফিরে ফুটবল থেকে বিদায় নেন। মাঝে ৯১ সালে ফরাসগঞ্জে ক্লাবে একবছর খেলেন।
ফুটবলার আজমত জাতীয় লের হয়ে খেলার সুযোগ পান ১৯৮০ সালে। সেবার অনুর্ধ্ব-১৯ ওয়ার্ল্ডকাপ এশিয়া বাছাই পর্বের খেলায় প্রথম সুযোগ পান স্টপার ব্যাক পজিশনে। পরের বছর ৮১ সালে জাতীয় দলের মূল দলে ডাক পান। সেবার প্রথমবারের মতো কায়েদে আজম ট্রফি খেলতে পাকিস্তান যান। টানা আট বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। এর মধ্যে ৮৫ সালে প্রথম সবুজ দলের অধিনায়কত্ব করার সুযোগও পান। ৮৬ তেও তার অধিনায়কত্বে পাকিস্তান কায়েদে আজম ট্রফিতে খেলে বাংলাদেশ। তবে ৮৮ সালে অনেকটা অভিমান করেই জাতীয় দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। সেসময় সিউল এশিয়ান গেমসের জন্য বিকেএসপিতে ক্যাম্পিং শুরু হয়।
আজমত ক্যাম্পিং-এ অংশ নেন। জাতীয় দলের কোচ তখন কাজী সালাহউদ্দিন। কোচ সালাহউদ্দিন ঠিক করে নে আজমতকে রাউট উইং-এ খেলতে হবে। কিন্তু বয়সের কারণে আজমত স্টপার ব্যাক ছাড়া খেলবেন বলে অটল থাকেন। কারণ রাইট উইং এ খেলতে গেলে যে পরিশ্রম করতে হয় সেটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ বিষয়টির একটি সুন্দর নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে আজমত নিজেই ক্যাম্প ত্যাগ করে বাফুফেতে এসে প্রত্যাহারপত্র জমা দেন। এরপর আর কখনই তিনি জাতীয় লের হয়ে খেলেননি।
৯২ সালে ফুটবল থেকে সরে যাওয়ার পর ফুটবল কোচিং-এ যাত্রা শুরু করলেও তিনি টেকসই হতে পারেননি। বাংলাশে নৌবাহিনী, ধানমন্ডি ক্লাবে কোচ হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে মন সায় না দেওয়ায় ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে চলে যান মাতৃভুমি গাজীপুরে।
শেষজীবনে গাজীপুরের হারিনালেই আজমতের চিরবসতি। স্ত্রী আর দুইছেলেকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে পর্তুগালে থাকেন, ছোট ছেলে অর্ণব তার কাছেই।
আজমত বলেন, ‘জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার সবটুকুই ফুটবল থেকে। অর্থ, সম্মান, পরিচিতি, মানুষের অনিঃশেষ ভালবাসা সবই ফুটবল থেকে। হাসতে হাসতে আরও বলেন, প্রথম ৭৭ সালে মোহামেডানের পক্ষে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেলাম সেই স্মৃতি হ্নদয়ে অমলিন হয়ে আছে।
তিনি বলেন, সুপার লীগের এই খেলায় প্রতাপ শংকর হাজরাকে সেকেন্ড হাফে তুলে আমাকে নামানো হয় রাইট আউট পজিশনে। ঐদিন খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছিলো। আমি মাঠে নামার পরপরই হয়ে গেলাম টেলিভিশনের খেলোয়াড়। সেই অপরুপ স্মৃতি ভোলার নয়। ফুটবল নিয়ে আজমতের কোনো দুঃখ নেই। তবে অতৃপ্তি তাঁর একটাই। দীর্ঘদিন ঘরোয়া লীগে খেললেও কোনো দলেরই অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পাননি। তাঁর মতে, যে দলে গিয়েছেন তখনই তিনি অধিনায়কত্ব করার সুযোগটা পাননি। ফলে এই অতৃপ্তি নিয়েই তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বর্ণযুগের ফুটবলের সাথে বর্তমান সময়ের ফুটবলকে তিনি কোনোভাবেই মেলাতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘আগেতো সবকিছুই ছিল ফুটবল ঘিরে। সেই ক্রেজ, ফুটবলের প্রতি সেই ভালবাসা এখন আর নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। ফুটবলে যে অপরুপ সৌন্দর্য ছিল তা হারিয়ে গেছে।’
আজমত আলী বলেন, ‘ফুটবলের পুরনো স্মৃতিই কেবল আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে মৃত্যুঅব্দি।’
কিন্তু আজমত আলীর জীবন থেকে সেই আনন্দ কেবলই দূরে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। নিউরো এবং হার্টের নানা সমস্যায় জর্জরিত। তেমন একটা হাঁটা চলা করতে পারেন না। বাসাতেই থাকেন। তাঁর খবরও ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কেউ রাখেন না বলে তিনি জানান।