যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও তার পরিচালক জেমস কোমি ই-মেইল কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। কিন্তু যে এফবিআই নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের জন্য লাভজনক প্রমাণিত হয়েছিল, সেই এফবিআই-ই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাকে ফাঁদে ফেলার অস্ত্র।
এ বছরের প্রথম থেকেই মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে তথ্য দিতে জেমস কোমিকে চাপ দিয়ে আসছিলেন কংগ্রেশনাল তদন্তকারীরা। তাদের অবশ্য বারবারই দমিয়ে দিয়েছেন কোমি। তবে এবার তিনি ঘোষণা দিয়েই দিলেন, রুশ সরকার নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষ হয়ে কোনো
প্রভাব রেখেছে কি না, এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে এফবিআই। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প এবং জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের ফোনে ওবামা প্রশাসন আঁড়ি পেতেছিল – ট্রাম্পের এমন অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ না পাওয়ার কথাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এফবিআই প্রধান।
এখন পর্যন্ত যে তথ্যগুলো নিশ্চিত সেগুলো হলো:
বর্তমানে একটি সক্রিয় তদন্তকাজ চলছে
কংগ্রেসের গোয়েন্দা কমিটির উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে হালকাপাতলা বাকবিতণ্ডা এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএ’র প্রধান মাইক রজার্সের প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর কোমি ঘোষণা দেন চলমান তদন্তের কথা।
তিনি জানান, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রুশ সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল কি না, এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তাকে অনুমতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের তৎকালীন প্রচারণা শিবিরের কারও সঙ্গে রাশিয়ার সংযোগ থাকলে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে বলে উল্লেখ করেন কোমি।
এই ঘোষণায় ট্রাম্প আর তার সমর্থকরা খুব একটা সন্তুষ্ট না হলেও হিলারি আর ডেমোক্র্যাটরা যে খুব খুশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা হিলারি এখনো অভিযোগ করেন, অসময়ে এফবিআইয়ের ওই ইচ্ছাকৃত তদন্ত এবং নিয়ম বহির্ভূত ঘোষণার কারণেই প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি তিনি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন জিতে যান, সেজন্যই সংস্থাটি হিলারির বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে তদন্তকাজ শুরু করে।
ট্রাম্প টাওয়ারে ওবামার আঁড়িপাতার পক্ষে ‘কোনো প্রমাণ নেই’
নির্বাচনের আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ফোনে আঁড়িপাতার যে অভিযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছিলেন, তার কোনো প্রমাণ নেই বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে এফবিআই।
হাউজ ইন্টেলিজেন্সের ওই বৈঠকেই এফবিআই প্রধান কোমি বলেন, ‘আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই যা ট্রাম্পের দাবিকে সমর্থন করে।’
তিনি বলেন, বিচার বিভাগ এবং এফবিআইয়ের তদন্তে ফোনে আঁড়িপাতার কোনো প্রমাণ মেলেনি। কোনো প্রেসিডেন্ট কারও বিরুদ্ধেই এমন আদেশ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না বলেও জোর দেন কোমি।
দাবি থেকে পিছু হটছেন না ট্রাম্প
কেউ যদি ভেবে থাকেন এরপর ট্রাম্প তার দাবি থেকে সরে আসবেন, শান্ত হবেন, তবে তার ধারণা ভুল। কেননা কংগ্রেসের শুনানি শেষ হতে না হতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অফিশিয়াল টুইটার পেজ থেকে একের পর এক টুইটবার্তায় দাবি করা হয় যে, এনএসএ এবং এফবিআই নিশ্চিত করেছে রাশিয়া নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেনি। যদিও বাস্তবে সংস্থা দু’টি শুধু ভোটগণনায় রুশ সম্পৃক্ততা না থাকার কথা বলেছে।
শুধু তাই নয়, টুইটে বলা হয়েছে, কিছু ব্যক্তিকে (যেমন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন) রাশিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে।
আবার জেমস কোমি উল্টোটা বললেও টুইটে দাবি করা হয়েছে, কোমি বলেছেন ওবামা প্রশাসনের ফোনে আঁড়িপাতার ক্ষমতা ছিল এবং ওবামা রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ফ্লিনের আলোচনার ব্যাপারে জানতেন – এ কথা কোমি অস্বীকার করেননি।
মূলত ‘ট্রাম্প-রাশিয়া জোগসাজশের গুজব’ ওবামা সরকার বা ওবামা নিজেই ছড়িয়েছেন বলে দাবি করেছে টুইটগুলো।
এখনো যে তথ্যগুলো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি সেগুলো হলো:
তদন্তের শেষ কবে?
নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়ে এফবিআইয়ের তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে জানিয়েছেন জেমস কোমি। তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগতে পারে তার কোনো ঠিক নেই বলেও জানান তিনি। শুধু বলেছেন, প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল।
‘রাশিয়া হস্তক্ষেপ কাহিনী’ ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ট্রাম্পকে কিছুটা যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সংযোগগুলো ফাঁসকারীকে খুঁজে বের করতে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা বারবারই কেন যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬’র নির্বাচনে রুশ প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য শেষ সময়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন ওবামা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, যেন সবাই তা জানতে পারে।
তদন্তটির লক্ষ্যবস্তু কে?
এফবিআইয়ের এই তদন্ত নির্দিষ্ট অভিযোগ বা প্রমাণের ভিত্তিতে কাকে/কাদেরকে নিয়ে করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে যতবারই প্রশ্ন করা হয়েছে, ততবারই কোমি নিশ্চুপ থেকেছেন।
তিনি কি ট্রাম্প নির্বাচনী শিবিরের সাবেক ম্যানেজার পল ম্যানাফোর্ট, যার সঙ্গে রুশপন্থি ইউক্রেনিয়ান রাজনীতিকদের সম্পর্ক ছিল? – মন্তব্য নেই।
তিনি কি ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা রজার স্টোন, যার সঙ্গে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ইমেইল হ্যাকারের যোগাযোগ ছিল বলে কথিত আছে? – মন্তব্য নেই।
তিনি কি সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন? – মন্তব্য নেই।
কোনো ‘আমেরিকান ব্যক্তি’র সম্পর্কেই আপাতত কিছু বলতে চাইছেন না এফবিআই প্রধান। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কারও প্রতি সরাসরি আঙ্গুল না তুললেও কাউকে সন্দেহ আর অস্বস্তির তালিকা থেকে বাদ যেতেও দিচ্ছেন না তিনি।
ফলে আসলে যে কী ধরণের তথ্যপ্রমাণ আসছে, বা সেগুলো আদৌ কতটা বাস্তব, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেও পারে।
রিপাবলিকানরা কী করবেন?
প্রার্থীতার লড়াই চলাকালে দলের খুব বেশি সমর্থন কিন্তু ট্রাম্প পাননি। ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরে যাওয়া, অর্থের ক্ষমতা এবং নেতিবাচক প্রচারণাকে নিজের সুবিধায় কাজে লাগিয়ে রিপাবলিকান দলের প্রার্থীতা জেতেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জেতার পরও দলের বহু সিনিয়র নেতা ছিলেন তার বিপক্ষে।
অবশ্য বিভিন্ন বিতর্ক হলেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সার্বিকভাবে ট্রাম্প দলের সমর্থন পেয়েছেন।
তবে ‘বিতর্ক’ আর ‘প্রমাণ’ দু’টি ভিন্ন জিনিস। এফবিআইয়ের তদন্তে কোনোভাবে যদি প্রমাণ হয়, নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ ছিল এবং ট্রাম্পের বিজয়ে সেটি ভূমিকা রেখেছে, তবে রিপাবলিকানরা যে আর ট্রাম্পের পেছনে থাকবেন না, সেটা অনেকাংশেই নিশ্চিত।
তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সব মিলিয়ে এফবিআইয়ের তদন্ত হয়ে উঠতে পারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য ফাঁদ – এমনটাই মনে করছেন অনেকে।