একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কী পরিমাণ মনোযন্ত্রণা থেকে বলতে পারেন-তাঁকে যেন মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেওয়া হয়। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলছেন্না গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধার নাম মো. আবুল হোসেন। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন।
‘একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বিবেকের তাড়না আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বীর উপাধি পেয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিবাদস্বরূপ ‘‘বীর’’ উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যতদিন বেঁচে থাকব একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকতে চাই। আর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেব না। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তো দাফনের সময় একই মর্যাদা পাবেন।’
কথাগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেনের। গত ১৬ ডিসেম্বর একটি শীর্ষ দৈনিকে সংবাদটি প্রকাশ পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একাত্তরে। ৪৬ বছর পরও যদি দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে তালিকা করা হয়, তা হলে তো সুযোগ সন্ধানীরা দলবাজি করে নিজেদের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযুক্ত করবেই। এই যে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার জন্য যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয় সেখানে কাদেরকে রাখা হয়, সেটাও দেখার বিষয়। তাদের মধ্যে থেকে কেউ না কেউতো টাকার বিনিময়ে একজন অমুক্তিযোদ্ধাকেও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করবেই। কারণ এই কমিটিতে সরকার দলীয় প্রভাবশালী সাংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা থাকেন।
যারা জানেন না একাত্তরে একজন মুক্তিযোদ্ধা কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। এই কমিটির লোকজনদের অনুভূতি নেই, বোধ নেই, বিবেক তো মারাই গেছে। এরা টাকা পেলে সব কিছু করতে পারেন।
অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়ার বিষয়টিও খবরের কাগজে এসেছে। তারপরও কি টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের?
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
কেন নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার প্রয়োজন পড়ে? কেন সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরনো তালিকা থেকে কিছু নাম বাদ পড়ে, কিছু নাম সংযোজন করা হয়?
এর অর্থ হচ্ছে প্রতিবারই সরকার আসে আর নিজেদের কিছু লোকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। আর কিছু লোককে বাদ দেওয়া হয়। যারা আগের সরকারের আমলে দুই নম্বরি করে যুক্ত হয়েছিলেন। এই যে যারা যুক্ত হয়েছিলেন, আবার তারা সরকার বদলের সাথে বিযুক্ত হলেন তারা কারা? তাদের কি আদৌ কোনো সামাজিক মর্যাদা আছে? তারা কি অপমানিতবোধ করেন? হয়ত করেন না, কারণ তারা জানেন মুক্তিযোদ্ধার সিলটা গায়ে লাগাতে পারলে অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। সন্তানের চাকুরী থেকে শুরু করে নানা জায়গায় তদবির করে লাভবান হওয়া যাবে। তা হলে কি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ উপাধি একটা জাদুর কাঠি? একাত্তরে সবাই কি এই জাদুর কাঠির জন্য ঘর থেকে বের হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন?
এ রকম নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মনে। কোনো উত্তর মেলে না। কারণ প্রতিবারই সরকার বদল হওয়ার পর আমাদের একই চিত্র দেখতে হয়। আর তাই তো অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেনের মতো মানুষদের কথা পড়তে হয়।
এই অভিমানকে শুধু অভিমান হিসেবে দেখার পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান হিসেবে দেখা দরকার।
একজন মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাঁর বীরত্বের জন্য তাঁকে খেতাব দেওয়া হয়েছিল। আর যে মানুষটি যুদ্ধেই যায়নি, তাকেও খেতাব দেওয়া হচ্ছে, তা হলে কিসের সম্মানে সম্মানিত হলেন তিনি? তার নিজের কি একটুও খারাপ লাগে না মিথ্যে সম্মান পেতে বা নিতে? শুধু রাজনৈতিক কারণে জোর করে নিজে সম্মানিত হতে চাচ্ছেন। এই রাজনীতির কি মূল্য আছে?
রাজনৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় দেশে বর্তমানে বিরাজমান তা থেকে যতদিন বের হয়ে আসা না যাবে ততদিন আমাদের এই নীতি-নৈতিকতার স্খলন ঘটবেই। আমরা দেখব প্রতি সরকারের আমলে নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের চেহারা।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি থাকল সশ্রদ্ধ সালাম। আপনাদের জন্যই আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। স্বাধীন মানচিত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)