রাজশাহীর পুঠিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এজাহার বদলে দেওয়াসহ সব অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পুঠিয়ার ওই হত্যা মামলার এজাহার বদলে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে নিহত ব্যক্তির মেয়ের করা রিটের শুনানি নিয়ে রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কিছু নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণসহ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিক। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও অমিত তালুকদার।
আদালত রায়ে বলেছেন, ‘ওসির মতো দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর, যা দণ্ডবিধির ১৬৬ ও ১৬৭ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। থানায় এজাহার গ্রহণ ও তা রেকর্ডভুক্ত করার বিষয়টি ওসির একক এখতিয়ার। ওই ধারা দুটি ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলভুক্ত। সে কারণে এ–সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের বক্তব্যসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠাতে রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হলো। প্রতিবেদন ও কাগজপত্র পাওয়ার পর দুদক আইন ও বিধি অনুসারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করতে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হলো।’
এছাড়া হাইকোর্ট এ হত্যা মামলা (নুরুল ইসলাম) পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার মামলাটি তদন্ত তদারকিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রায়ে বলা হয়, তদন্তকালে মূল এজাহারের (নিহত ব্যক্তির মেয়ে) বর্ণনা, বিচারিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও অনুসন্ধান কার্যক্রমে সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনায় নেওয়ার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ে আরো বলা হয়, সাময়িক বরখাস্ত ওসি সাকিল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলার সংবাদদাতা (বাদী), তাঁর অধীনস্থ পুলিশ সদস্যসহ একাধিক ব্যক্তি, এমনকি তাঁর শাশুড়িও বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রতিকার চেয়ে আইজিপি বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন। সাকিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইজিপিকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
এ রায়ে আদালত বলেছেন, পুলিশ সুপারের পক্ষে দাখিল করা হলফনামা পড়ে ওই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেলও এ বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। গ্রেপ্তার আলোচ্য ক্ষেত্রে একজন শিশুর তর্কিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করে রাজশাহীর পুলিশ প্রশাসন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। শিশুর জবানবন্দি গণমাধ্যমে প্রকাশ করার বিষয় সম্পর্কে বিভাগীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইজিপিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
শিশু আইন সম্পর্কে মাঠপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের সচেতনতামূলক ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, এ বিষয়ে আইজিপিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলো। এ ছাড়া হাইকোর্ট মামলার সংবাদদাতা (বাদী), সাক্ষী, নিহত নুরুল হকের পরিবার ও তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান করতে রাজশাহীর পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ইদানীং প্রায়ই লক্ষ করছি যে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীরা পুলিশের আইজিপি বরাবর লিখিত অভিযোগও দায়ের করছেন। কিন্তু অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বাংলাদেশ পুলিশ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা ও উন্নয়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, জাতিসংঘ মিশনের কার্যক্রমে অনবদ্য অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে ও রেখে চলেছে। এটি শুধু পুলিশ বাহিনীর জন্য গৌরবের নয়, সমগ্র জাতির গৌরব। কিন্তু এই গৌরব গুটিকয়েক পুলিশ কর্মকর্তার বা সদস্যের অন্যায়, বেআইনি আচরণ ও অপরাধের কারণে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না।
রাজশাহীর পুঠিয়ার একটি ইটভাটা থেকে গত ১১ জুন নুরুল ইসলামের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর মেয়ে নিগার গত ১১ জুন পুঠিয়া থানায় আবদুর রহমান পটলসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে এজাহার দাখিল করেন। তবে বিচারিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, পুঠিয়া থানার তৎকালীন ওসি গত ১১ জুন বাদীর দাখিল করা এজাহারটি গ্রহণ না করে পরবর্তী সময়ে তাঁকে থানায় ডেকে নিয়ে জব্দ তালিকা, সুরতহাল প্রতিবেদনসহ কিছু সাদা কাগজের ওপর সই করিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সই করা ওই সাদা কাগজে এজাহার টাইপ করে তা রেকর্ডভুক্ত করা হয়। বাদী কর্তৃক থানায় দাখিল করা এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে দায়ের করা এজাহারের বর্ণনার মধ্যে অসংগতি বিদ্যমান। সর্বোপরি এজাহারে আসামি কলামে ‘অজ্ঞাত’ উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বাদীর এজাহারে আটজনের নাম অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।