বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ৩৮ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এক সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন একই ব্যাচের সদস্যরা।
কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি অন্যায় করে ফেলেছেন, হয়তো নিজেকে শুধরে নেবেন, ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে দেশ ও জাতিকে সেবা করবেন; এ আশায় আমরা তার বিস্তারিত পরিচয় উল্লেখ করছি না, কিন্তু বিষয়টা আলোচনায় থাকা উচিত যাতে তিনি বা অন্য কেউ এরকম ভুল আর না করেন।
বিসিএস ৩৮ ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই একই ব্যাচের সহকর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসা, খাদ্যসামগ্রী বিতরণসহ সরকারি তথ্য সেবা নম্বর ৩৩৩ কোড ব্যবহার করে সরকারি তহবিল গঠনের কথা বলে সদস্যদের কাছে ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন ওই নারী কর্মকর্তা। পরে সংগ্রহ করা অর্থ তিনি বিতরণ না করে নিজে আত্মসাৎ করেছেন।
অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ৩৮ ব্যাচের সদস্যরা বুঝতে পারলেও এখনও তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সক্ষম হননি। এক পর্যায়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্যাচের সদস্যদের কাছে ক্ষমা চান ওই কর্মকর্তা।
তার ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের অনুরোধ করে মন্ত্রী পরিষদ সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে অভিযোগ করে চিঠি পাঠিয়েছেন বিসিএস ৩৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এছাড়াও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।
বিভাগীয় তদন্তের অনুরোধ করে দেওয়া চিঠির একটি অনুলিপি চ্যানেল আই অনলাইন-এর কাছে আছে।
অভিযুক্ত কর্মকর্তা একটি জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশিক্ষণরত)। তার স্বামী বিসিএস ৩৫ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনিও ওই জেলা সদরের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা। প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া করেছেন সেখানে শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ও তিনি ত্রাণ ও দরিদ্রদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিসিএস হওয়ার আগে তিনি একটি বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থায় কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিভাগীয় তদন্তের অনুরোধের চিঠিতে যা ছিল
বিভাগীয় তদন্তের অনুরোধের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাদের ৩৮ ব্যাচের ও একজন সহকারী কমিশনার (নাম উল্লেখ করা হলো না) ক্যাডার পরিবার গ্রুপে তার নিজস্ব ফেসবুক আইডি (যা বর্তমানে নিষ্ক্রিয় আছে) থেকে ০১৭৪৬৩২০৮৮৪/০১৭৭২১১৭১৮০/০১৬২৯৯২০৫৩৯ এবং ব্যাংক একাউন্ট নম্বর-০৩৩০১০১০১৫৫৭০ এর বিপরীতে ৩৮ ব্যাচের পিএসসি’র সুপারিশপ্রাপ্তির পর থেকেই বিভিন্ন অযুহাতে প্রথমে অসহায় ছাত্রকে পরে সরকারি তথ্য সেবা নম্বর “৩৩৩” কোড ব্যবহার করে সরকারি তহবিল গঠনের কথা বলে তা সদস্যদের ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
ফেসবুক আইডিটি থেকে বিভিন্ন জনের কাছে মোবাইলসহ অন্যান্য মাধ্যমযোগে সরকারি ফান্ড বলে যে ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বর দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে ঠিক একই তথ্য বাতায়নে তার যোগাযোগ নাম্বার হিসাবে নিবন্ধিত বলে দেখা গেছে ।
অভিযোগে বলা হয়, ৩৩৩ কোড ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করায় বিষয়টি তাদের কাছে সন্দেহের মনে হওয়ায় তার বিষয়ে খোঁজ করে জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও তিনি একই কাজ করেছেন এবং এভাবে অর্থ সংগ্রহ সিভিল সার্ভিসের মর্যাদাকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করে।
‘‘বিষয়টি নিয়ে তাকে অবহিত করা হলে নানাবিধ অজুহাত দেখালেও একপর্যায়ে দোষ স্বীকার করে এবং ক্ষমা চেয়ে ৩৮তম বিসিএস সদস্যদের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেন। তার এই কর্মকাণ্ড সত্য হলে তা সিভিল সার্ভিসের মর্যাদাই শুধু ক্ষুণ্ন করবে না উপরন্তু তিনি রাষ্ট্রের জন্য মোটেও নিরাপদ নন বলে আমরা শঙ্কা প্রকাশ করছি। তাই নবীন কর্মকর্তা হয়ে আমরা আমাদের নৈতিক অবস্থান থেকে ব্যাপারটির অধিকতর বিভাগীয় তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।”
যা বলছেন অভিযোগকারীরা
বেশ ক’জন ভুক্তভোগী ক্যাডার সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে অসহায় শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার খরচ, কখনও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার কথা বলে অর্থ সংগ্রহ করতেন ওই নারী কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘অমাদের বিসিএস ৩৮ ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে প্রায় এক হাজার ৮০০ জনের মতো আছি। অধিকাংশ সদস্যের কাছ থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আনুমানিক যদি এক হাজার সদস্যও তাকে নূন্যতম ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দিয়ে থাকেন, তাহলেও টাকার পরিমাণ অনেক।’
বিসিএস ৩৮ ব্যাচের বক্তব্য
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ৩৮তম ব্যাচের মুখপাত্র শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা ও রংপুর সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক এস এম আব্রাহাম লিংকন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, প্রতারণা সত্য হলে এমন কাজ সিভিল সার্ভিসের মর্যাদাই শুধু নষ্ট করবে না, উপরন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারের উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসা হ্রাস পাবে। আমরা চাই সরকার ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর যেন মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাস নষ্ট না হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ন্যায়বোধের জায়গা থেকে আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালকে চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়েছি।
‘রাষ্ট্রের বড় একটা পর্যায়ে থেকে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ব্যবহার করে অর্থআত্মসাৎ করায় আমরা শুধু সংক্ষুব্ধ নই, আমরা ভীতসন্ত্রস্তও।’
তিনি বলেন: আমরা চাই আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যারা আছেন তারা বিভাগীয় তদন্ত করে অভিযোগ সত্য হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। পাশাপাশি অভিযুক্ত কর্মকর্তা শুধুমাত্র নিজে জড়িত কিনা, নাকি তার কোন সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে সেটারও তদন্ত হোক।
অভিযুক্ত কর্মকর্তার বক্তব্য
অর্থ আত্মসাতের বিষয় নিয়ে জানতে একাধিকবার ওই সহকারী কমিশনারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি উত্তর দেননি।
তবে বিসিএস ৩৮ ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে এক পোস্টে তিনি তার ব্যাচের সদস্যদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন, যা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে রয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেছেন: আমার দ্বারা এই কাজ হওয়ার সম্পূর্ণ দায়ভার আমি নিচ্ছি এর জন্য আমি ভীষণভাবে অনুতপ্ত এবং লজ্জিত। এর ব্যাখ্যা দেওয়ার মুখ আমার নেই। আমি সকলের নিকট নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী। আমার দ্বারা ভবিষ্যতে এই ধরণের কোনো অন্যায় হবে না এর মুচলেকা আমি দিচ্ছি। টাকা যেহেতু কোথাও ট্রান্সফার হয়নি আমি রিফান্ড দিতে চাচ্ছি। সেটা কিভাবে করা যায় সেই ব্যাপারে সহায়তা করলে আমার জন্য একটু উপকার হতো। আমি খুব লজ্জিত, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি ক্ষমা চাই।
প্রশাসনের বক্তব্য
অর্থ আত্মসাতের বিষয় নিয়ে তার বর্তমান কর্মস্থলের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয় চ্যানেল আই অনলাইনের। জেলা প্রশাসক বলেন: তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের অভিযোগ এসেছে। আমরা সেটি তদন্ত করব। তদন্তে সত্যতা পেলে অবশ্যই যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এটা সরকারী কর্মকর্তার এক ধরনের অসদাচরণ। দোষী প্রমাণিত হলে তার গুরুদণ্ড হওয়া উচিত।
সরকার নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা করবে বলে আমরা আশা করতে চাই।