সুরের আদি উৎস কিন্তু প্রকৃতি। বাতাসের শব্দ, ঝর্ণার শব্দ, পশু পাখির ডাক, ঝড়ের শব্দ, পাতার শব্দ এসবই সুরের একেকটি খাঁটি উৎস। সংগীতের বনেদী সব যন্ত্রগুলো খেয়াল করলে দেখব সবই এই প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি! এগুলোর কোনোটাই তেমন উচ্চকিত নয়, অর্থাৎ আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয়ের যে স্বাভাবিক ক্ষমতা সেটিকে কোনোভাবেই আক্রান্ত করে না বা ক্ষতি করে না।
ইদানিং যে সব ইলেকট্রনিক বা ইলেকট্রিক যন্ত্র এসেছে সেগুলো অনেক বেশি কৃত্রিমতায় ভরা! কি-বোর্ড নামক যে যন্ত্রটি আছে, সেখানে দাবি করা হয় প্রায় সব দরকারি টোনই আছে, যেমন- সেতার, গীটার, নানা ধরণের বাঁশি, পিয়ানো, বেনজো, বেহালা ইত্যাদি। এতে সাশ্রয়ও হলো অনেক। একজনই সব বাজিয়ে দিলেন, বোতাম টিপে টিপে টোন চেঞ্জ করে!
কিন্তু আসলে কি হলো?
বেহালার সুর, সানাইয়ের সুর, হারমনিকার সুর কি কোনভাবেই এই কি-বোর্ড দ্বারা দেয়া সম্ভব! সংগীত সংশ্লিষ্ট সবাই মানবেন যে সেটা সম্ভব নয়। সেই কারণেই আমাদের প্রিয় স্বর্ণযুগের শিল্পীদের গানগুলো যখন ইদানিং আবার রেকর্ড করছেন এখনকার কোনো গুণী শিল্পী, সামগ্রিক বিচারে সেই মানের ধারে কাছেও পৌঁছয় না! উদাহরণ স্বরূপ একটি গানের কথাই উল্লেখ করি,- প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই মধু মাখা ‘একটা গান লিখ আমার জন্য’, এই গানের শুরুতে যে প্রিলিউড আছে কোনো রিমেকেই তা ঠিক সুরে দিতে শুনিনি! এ থেকে সেকালের শিল্পী, আর এ কালের শিল্পীদের মানের প্রশ্নে খুব বড় ধরণের একটা গ্যাপ স্পষ্ট। এসব গানের ইন্টারলিউড, প্রিলিউড সবই সবার মুখস্ত! এগুলোও গানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এখনকার ইলেকট্রনিক যন্ত্র দিয়ে যখন এস্রাজ, বেহালা, বাঁশি, সরোদ এসবের কাজ দেয়া হচ্ছে তা কানে তেমন মধু ঢালতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আমাদের নিজের যে সংগীত, যা স্বাস্থ্যকর, যা আমাদের মনকে ভালো হতে প্রেরণা যোগায় আমরা কিন্তু সেদিক থেকে ক্রমশই দূরে হাঁটছি! অনেক গান হারিয়ে গেছে, অনেক বাদ্যযন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীর সব সভ্য দেশ বা সমাজেই এ ধরণের ব্যাপারে রাষ্ট্র, সমাজের প্রচেষ্টা থাকে, যাতে এই বৈচিত্র্য ধরে রাখা যায়।
পাকিস্তানের একটি প্রদেশে এমন একটি প্রচেষ্টার কথা জানতে পারলাম ডন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ব্লগ থেকে। যা আমাদেরও প্রেরণার উৎস হতে পারে। সৈয়দ মেহদি বুখারির এই ভ্রমণ কাহিনী থকে কিছুটা অনুবাদ করে দেয়া হলো:
বলা হয়ে থাকে, সম্রাট আকবর তার নবরত্নের অন্যতম তানসেনকে জিজ্ঞেস করেন- তানসেনই পৃথিবীর সবচেয়ে সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী গায়ক কি না! তানসেন জানান,- তিনি নন তার শিক্ষক স্বামী হরিদাসই বিশ্বের সেরা গায়ক! আকবর স্বামীজিকে তার রাজ সভায় পেতে চাইলেন, কিন্তু স্বামীজি নিরিবিলি থাকাই পছন্দ করেন; তিনি অপারগতা জানান। অগত্যা আকবর নিজেই তার কুটিরে হাজির হন।
কিন্তু স্বামী হরিদাস তো গান গাইছেন না! আকবর কয়েকদিন অপেক্ষা করেন। তানসেন সম্রাটকে জানিয়েছিলেন, হরিদাস নিজে চাইলেই কেবল গান গেয়ে থাকেন। অবশেষে তানসেন গান গাইতে শুরু করেন, ইচ্ছে করেই একটু বেসুরো গাইলেন! স্বামী হরিদাস তাকে ঠিক করে দেয়ার জন্য গাইতে আরম্ভ করলেন! আকবর স্বীকার করলেন স্বামী হরিদাসই সেরা! তখন এর কারণ হিসেবে তানসেন বলেছিলেন, ‘মহামান্য সম্রাট, স্বামীজি নিজের ইচ্ছায় গান করেন, আর আমি গান করি আপনার হুকুমে।’
পাকিস্তানের সর্ব উত্তরে গোজাল উপত্যকার অবস্থান। এটি গিলগিট বালতিস্থান অঞ্চলের বৃহত্তম তেহসিল বা প্রশাসনিক বিভাগ। গোজালে রয়েছে ছোট বড় উপত্যকায় সারি, যা একদিকে আফগানিস্তান অন্যদিকে চায়না পর্যন্ত বিস্তৃত। দিওসাই নামক বিস্তৃত সমতলে বসেছিলাম, চারিদিকে বুনোফুল, ঝিরঝিরে বাতাস, পাশের বয়ে যাওয়া লেকের পানির শব্দ। নিজেকে হারিয়ে ফেললাম! আমার মনে হল, যেন স্বামী হরিদাস কাছে কোথাও গান গাইছেন! হুনজা নদীর ধারে গুলমিট গ্রামে নদীর ধারে বসেই ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছিলাম। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি, এমনি সময় কোথা থেকে যেন ভেসে এল রবাবের সুর! স্থানীয়দের এই রবাবের উৎস সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। তারা পাশের একটি দালান দেখিয়ে দিল। ট্র্যাডিশনাল পামিরি স্টাইলে নির্মিত। এটি একটি মিউজিক স্কুল, USAID’র অর্থনৈতিক সহায়তায় পরিচালিত। দিদার আলী, এই প্রোজেক্টের লিডার, আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে তরুণ, তরুণীরা রবাব, বাঁশি, সেতার ও অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল যন্ত্র বাজাচ্ছে!
আলী আমাকে জানালেন, ওয়াখি ভাষা ও সংস্কৃতির মতো সঙ্গীতও বিলুপ্তির হুমকির মুখে আছে! ‘পুরো গোজালে এখন মাত্র একজন আছেন যিনি Ghazxek নামক যন্ত্র বাজাতে জানেন। আমরা এই প্রোজেক্ট চালাচ্ছি আমাদের সংগীতকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘বুলবুলিক’ এর অর্থ বুলবুলির গান’- আলী জানান। নিজের সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা, তাকে টিকিয়ে রাখার সব রকম চেষ্টা দেখে আমি অভিভূত। তবে ইউএসএআইডির এই ফান্ড মাত্র এক বছরের। তারপর এর ভবিষ্যৎ কি হবে! এই প্রোজেক্টের ঠিকঠাক ফল পেতে হলে আরও বেশ ক’বছর চালানো একান্ত প্রয়োজন। যে কোনো প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা দাতা এ বিষয়ে এগিয়ে এলে অনেক বড় একটি কাজ হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)