বাংলাদেশে গত এক দশকে ১১টি নতুন ব্যাংক ও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শাখা খোলা হয়েছে। এছাড়াও অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে নতুন আরো ৩টি। সেগুলোর কার্যক্রম চালু হলে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে যাবে। বাড়বে শাখার সংখ্যাও।
কিন্তু ব্যাংকিং খাতের এ ধরনের প্রসারকে আর্থিক খাতে ইতবাচক মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সব মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাতের পরিধি বাড়ানো হলেও তা আর্শীবাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের অভিমত, রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত ১০ বছরে ১১টি নতুন ব্যাংক চালু ও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শাখা খোলা হলেও এতে আর্থিক খাতে সুফল বয়ে আনেনি। বরং তৈরি হয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। সৃষ্টি হয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে অর্থাৎ ১০ বছর আগে বাংলাদেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৪৭টি। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের অপেক্ষায় আরো ৩টি।
ব্যাংকের পাশাপাশি শাখাও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকের মোট শাখা ছিল ৬ হাজার ৮৮৬টি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শাখাসংখ্যা বেড়েছে আরো ৩ হাজার ২২৮টি। বর্তমানে গ্রাম এবং শহরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট শাখা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১১৪টি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও তিনি আবার নতুন ব্যাংকের জন্য সুপারিশ করেন।
ব্যাংকিং খাতের এলোমেলো অবস্থা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে দুই ধরনের ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। একটা হলো- ইউনিট ব্যাংকিং অন্যটি হলো ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং। ইউনিট ব্যাংকিং চালু আছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে একেকটি ব্যাংক একেকটি দোকানের মত। হাতে গোণা অল্প কয়েকটি শাখা নিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরণের হাজার হাজার ব্যাংক রয়েছে।
অন্যদিকে ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে যুক্তরাজ্যে। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ব্যাংকের সংখ্যা থাকে তুলনামূলক কম। কিন্তু শাখাসংখ্যা বেশি। যেমন, হয়তো একটি দেশে ১০টি ব্যাংক আছে এবং সেগুলোর শাখাসংখ্যা ৫০ হাজার। এ ৫০ হাজার শাখার মাধ্যমে তারা ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।
যুক্তরাজ্যের মত ভারতেও ব্যাংকের সংখ্যা অনেক কম। এত বড় একটি দেশে মাত্র ১৮টি ব্যাংক। কিন্তু এসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে হাজার হাজার। যেমন-স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার শাখার সংখ্যা ২৪ হাজার। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং পদ্ধতির আদলে আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দুই পদ্ধতির কোনোটির সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ নেই বাংলাদেশে।
“বাংলাদেশে ২০ টির বেশি ব্যাংক থাকা উচিত নয়। কিন্তু অনেক বেশি। এ কারণে ব্যাংকগুলোর মধ্যে খারাপ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। বড় ব্যাংকগুলোর সাখে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না ছোট অর্থাৎ নতুন ব্যাংকগুলো। ফলে তারা গোপনে গ্রাকদের বেশি বেশি ঋণ দিয়ে থাকে। বিভিন্ন কারণে লোকসানে পড়ে যায়।”
তবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় বর্তমানে আর্থিক খাতে দূরবস্থা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রামে শাখা খোলা হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম। শহরভিত্তিক শাখার সংখ্যাই বেশি। শহরে রয়েছে ৫ হাজার ২২৪টি এবং গ্রামে ৪ হাজার ৮৯০টি।
যদিও ব্যাংকের শাখার খোলার ক্ষেত্রে শহরে একটি খোলা হলে গ্রামেও একটি খুলতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু গ্রামে শাখা খোলার ক্ষেত্রে এখনও ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনিহা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইব্রাহীম খালেদ বলেন, নতুন ব্যাংকগুলো গ্রামে শাখা খুলতে পারবে না। তাদের সমস্যা হবে। কারণ মাত্র ৬০/৭০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে তারা ব্যাংক চালু করে। তাহলে এত অল্প পরিমাণ মূলধন নিয়ে কিভাবে গ্রাম পর্যায়ে যাবে?
এ বিষয়টি জানতে চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এক্ষেত্রে কিছু করার নাই। এছাড়া ব্যাংক শহরকেন্দ্রিক হবে না কি গ্রামে এজেন্টকেন্দ্রিক হবে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উপরই নির্ভর করে।
তবে আর্থিক খাতকে আরো প্রসারিত করতে এবং সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসতে ব্যাংকগুলোকে গ্রামে শাখা খোলার প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত বলে জানান তিনি।
ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখা বৃদ্ধির ফলে গত দশ বছরে ব্যাংকের মোট হিসাব সংখ্যা দাঁড়েয়েছে ৯ কোটি ২১ লাখে। এর বিপরীতে সঞ্চয় বা আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৬ কোটি থেকে ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৪ কোটিতে পৌঁছেছে।