কামরাঙ্গির চর। পূর্ব রসুলপুরের আট নম্বর গলির কথা এখন সবার জানা। কারণ এখানে বাস করেন ঢাকাইয়া গাল্লি বয়! হ্যাঁ, সেই ছোট্ট রানা। গেল এপ্রিলের শেষের দিকে রীতিমত চমকে দিয়েছিলেন অন্তর্জালে বাস করা বাংলার প্রতিটি শ্রোতা দর্শককে! যে র্যাপ সংগীতের তালে তালে নিজের জীবনের ধারা বর্ণনা করে গেছেন। বলে গেছেন তার জীবনের গল্প, দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং আশাবাদের কথা। অভিনব ঢঙে রানার ‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয়’-এর প্রশংসা ছড়িয়ে যায় চারদিকে। পেরিয়ে যায় দেশের গণ্ডি!
এবার নতুন চমকে হাজির ঢাকাইয়া গাল্লি বয়। আগের গানে নিজের দৈন্য-দশা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা বললেও এবার আরো সচেতন, চৌকস ঢাকাইয়া গাল্লি বয়! এবার শুধু নিজের কথা নয়, পাশাপাশি তার মতো এরকম অসংখ্য ছিন্নমূল কিংবা সুবিধাবঞ্চিত রানাদের কথা মেলে ধরেন। গানে গানে, সুরে সুরে, তালে তালে। প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘এক গান গেয়ে আমি আজ ভাইরাল, বাকি রানাদের বলো কী হবে কাল?’
মূলত এই রানাকে দিয়ে দেশের সব সুবিধাবঞ্চিত রানাদের কথা যিনি ছন্দে ছন্দে, র্যাপের আদলে তুলে ধরছেন, তিনি তবীব মাহমুদ। বর্তমানে তবীব পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। তবে গানের কথা তিনি লিখলেও সেটা রানার জীবনেরই কথা। কারণ তিনি রানার জীবনের গল্প শুনে গানগুলো বেঁধে তার মুখে সুরারোপ করে তুলে দিয়েছেন। কীভাবে রানাকে খুঁজে পেয়েছেন তবীব, সে গল্প চ্যানেল আই অনলাইনকে শুনিয়েছেন আগেই। এবার রানাকে নিয়ে তার কর্ম পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যত ভাবনার কথা জানালেন অকপটে:
‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয় পার্ট-টু’ করলেন। দর্শকের সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
বেশ ভালো অপ্রত্যাশিত ভালো। যেরকম আমাদের প্রত্যাশা ছিল সেই প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে গাল্লি বয়। ২৪ ঘন্টাতেই এবার ওয়ান মিলিয়ন ক্রস করেছে ভিউ। সাবস্ক্রাইব আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে একদিনেই।
আপনার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার কতো ছিল?
‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয় পার্ট-২’ দেয়ার আগে আমার সাবস্ক্রাইবার ছিল ৫৫ হাজার। এখন সেটা প্রায় দেড় লাখের মতো। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে দুই লাখের আরো বেশি মানুষ এটি পছন্দ করেছেন।
তো এখন রানাকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
আমাদের প্রজেক্ট অনুযায়ী গানগুলো করে যেতে থাকবো। এভাবে ‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয় পার্ট-৮’ পর্যন্ত করার প্ল্যান আছে আমাদের। আশা করি এখন যেভাবে হচ্ছে, সেভাবেই এগিয়ে যেতে পারবো।
র্যাপ সংগীতটা আমাদের এখানে সব মহলে ততটা জনপ্রিয় না। তারপরও জীবনের গূঢ় কথাগুলো বলার জন্য র্যাপকেই কেন টার্গেট করলেন?
আসলে র্যাপ গানের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই বেশ আন্তরিকতা ছিল। আমি সেই ছোট সময় থেকেই সব গান যেমন শুনতাম, তেমনি শুনে শুনে সেটা নিজেও গাওয়ার চেষ্টা করতাম। ওই ঢঙে ওই ভঙ্গিতেই গাইতে চেষ্টা করতাম। আর গান লেখার বিষয়টা এমনিতেই আমার মধ্যে ছিলো। বেসিক্যালি আমি কবি। ২০১৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয়। খুব একটা চলেনি, কবিতার বই তো মানুষ এখন এমনিতেই পড়ে না। পরবর্তী সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম তখন আমার মনে হলো, আমি যদি এমন কিছু কবিতা লিখি যেগুলি আবৃত্তি করলে মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করবে, বা কবিতার বই কিনবে, বা আমি যদি এমন কিছু করতে পারি যার জন্যে হলেও কবিতার বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরী হবে, হয়তো আমার বই কিনবে। সে ভাবনা থেকে আমার মাথায় র্যাপ গান করার নেশা চাপল। তো এরকম ভাবে যদি আমি ‘গাল্লি বয়’-এর মত পাঁচ ছয়টা গান করে সাড়া ফেলতে পারি, তাহলে মানুষের কনসেন্ট্রেশন ফেরানো সম্ভব। মানে আগে কবিতার বই মানুষ কেনো পড়তো, বা সাধারণ মানুষের কেন টান ছিলো! কারণ কবিতা মানেই ছন্দ ছিলো, মানুষ পড়তে ভালোবাসতো।
মানে কবিতাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হিপহপে মনোযোগ দিয়েছেন আপনি?
বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা এখন এমন বিষয় বস্তু নিয়েই লেখেন যেগুলো তাদের নিজেকেই আনন্দ দেয়, পাঠককের কথা ভেবে লেখেন না। এই যে আমি র্যাপ গাইছি, এরমাঝেও কিন্তু কবিতা আছে। র্যাপের ভাষা ই এমন, র্যাপের হিস্ট্রিতেও কিন্তু এমন আছে। আফ্রিকাতে মানুষ ছন্দে ছন্দে কথা দিয়ে প্রতিবাদ করতো, সেখান থেকে হিপহপ জিনিষটা আসছে। মানে আমি বলতে চাই যে পয়েট্রি রিদমের সঙ্গে আবৃত্তি হয় সেটাই হিপহপ। এখন যদি বাংলাদেশের কবিরা এমন কিছু কবিতা লেখা শুরু করেন, যেগুলো রিদমের সাথে আবৃত্তি করা যাবে দেখবেন পাঠক আবার কবিতার বই কিনতে শুরু করবে। এখনকার কবিতায় ছন্দ বা রিদম নাই দেখেই পাঠকও সেগুলো দুর্বুদ্ধ মনে করে এড়িয়ে যান। তবে কবিতায় ছন্দ ও রিদম দেয়ার মধ্য দিয়ে কবিতাকে পাঠকের মধ্যে আবারও জনপ্রিয় করার স্বপ্ন নিয়েই আমার এই হিপগপ প্রজেক্ট।
‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয়’- এর প্রথম গান ভাইরাল হওয়ার পর আপনার বা রানার বাস্তব জীবনে কি এর কোন প্রভাব পড়েছে?
না। রানার জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমি খোলাসা করে যদি বলি, এখন পর্যন্ত আমার কাছে প্রচুর কমার্শিয়াল অফার এসেছে, আসছে। টাকা পয়সার অফারও পেয়েছি। কিন্তু আমাদের যা উদ্দেশ্য, যেভাবে আমরা চাইছি তেমন কোনো প্রস্তাব পাইনি। আমাদের প্রজেক্ট যেভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তেমন কোনো প্রপোজাল আমাদের কাছে আসেনি। আমরা চেয়েছি সমাজের অনগ্রসর মানুষের জন্য কিছু করতে, রানার মতো অসংখ্য ছেলেমেয়ে আছে যারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, সুবিধাবঞ্চিত। তাদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি, কিন্তু সে মতন আন্তরিক প্রপোজাল আমাদের কাছে আসেনি। যা এসেছে সবই কমার্শিয়াল।
তো কী ভাবছেন এখন, কেমন প্রপোজাল প্রত্যাশা করছেন?
আমাকে এবং রানাকে টাকা পয়সা দেয়ার প্রস্তাব এসেছে কিন্তু যেসব কাজের জন্য এসব প্রস্তাব পাচ্ছি সেগুলো আমাদের দ্বারা করা সম্ভব না। আমাদের যে একটা শিল্পীসত্তা আছে, সেই সত্তাকে হ্যাম্পার করতে আমরা চাই না। প্রেম-পিরিতি কিংবা মিউজিক ভিডিওর মডেলিংয়ের গানে আমরা তো এখন কাজ করতে পারবো না। আমরা ওরকম নই, প্রেমের গানে আমাদের নাচানাচি করার স্কুপ নেই। কারণ আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছি, এগুলোতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন যা ইচ্ছা তা আমরা চাইলেও করতে পারি না। অথচ এখন পর্যন্ত যে প্রস্তাবগুলো আমাদের কাছে এসেছে, তার সবগুলোই এমন।
‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয়’-এর প্রথম গানের পর দৈনন্দিন জীবনে আপনার বা রানার জীবনে নিশ্চয় পরিবর্তন এসেছে?
না, আমাদের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে হ্যাঁ, এটা হয়েছে যে অনেক লোকজন এখন আমাদের চিনছে। তারা অন্যভাবে ট্রিট করছে, ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তবে এটা আমার কাছে পরিবর্তন বলে মনে হয় না। আমার মনে হয়, যখন কেউ কিছু করে তখন তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করবে, একটু অন্যভাবে মূল্যায়ণ করবে, এটা আমার কাছে জীবনেরই অংশ বলে মনে হয়।
রানাকে হেল্প করতে কেউ কি এগিয়ে এসেছে?
না, ব্যক্তিগত ভাবে হেল্প করার মত এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। অনেকেই হয়তো বলেন এই করবো সেই করবো কিন্তু পরবর্তীতে তার খবর পাওয়া যায় না। রানাকে আমি নিজ থেকেই আবাসিক একটি স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার চেষ্টা করছি, আগামী জানুয়ারি থেকে হয়তো ভর্তি করিয়েও দেবো।
রানার মা খুবই আন্তরিক। উনি তার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, আমার উপরে ভরসা করছেন যে, ভালো কিছু একটা হবে উনার ছেলে।