দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে হৃদরোগের প্রকোপ। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত হৃদরোগের বিস্তৃতি বেড়ে চলেছে। এ রোগে আক্রান্তদের বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। তবে শিশু হৃদরোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। হৃদরোগীদের জন্য সময় মতো ওষুধ খাওয়া এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
অনেক সময় দেখা গেছে এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রায়ই কখন কোন ওষুধ খেতে হবে তা ভুলে যায়।কিংবা কোন তারিখে চিকিৎসকের কাছে যাবেন সেটাও ভুলে যায় অনেকে। যদি রোগীকে ওষুধ খাওয়া, চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়টি অ্যালার্ম দিয়ে জানিয়ে দেয়া যায় তাহলে কেমন হয়?
হ্যাঁ, ঠিক তাই হবে। এখন থেকে দেশের হৃদরোগীরা ‘ইহার্ট’ নামে একটি অ্যাপে এক ক্লিকেই এসব সুবিধা পাবেন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে (এনএইচএফ) চিকিৎসাধীন হৃদরোগীদের জন্য সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সহায়তায় এই অ্যাপটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব।
ইহার্ট অ্যাপের সুবিধা
এনএইচএফ এ চিকিৎসাধীন রোগীর প্রোফাইল তৈরি করা হবে অথবা রোগীর স্মার্টফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করে রেজিস্ট্রেশন করে লগইন করলেই মিলবে ডিজিটাল সব সুবিধা। এই সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে রিস্ক স্কোর, অ্যাপয়েনমেন্টম প্রেসক্রিপশন, টেস্ট রেজাল্টস, রিস্ক ট্রেন্ড, ফলোআপ, হার্ট রেট অপশন।
রিস্ক স্কোরেও রোগীর ঝুঁকির সম্ভাব্যতা জানা যাবে। এজন্য রোগীর কোলেস্টেরল, সিস্টোলিক রক্তচাপ, বয়স, লিঙ্গ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপানের তথ্য ঝুঁকি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যবহৃত হবে। স্কোর অনুযায়ী রোগীর একটি গ্রাফ তৈরি হবে। অ্যাপের রিস্ক স্কোর অপশনে ক্লিক করে রোগী তার ঝুঁকির মাত্রা জানতে পারবে।
অ্যাপয়েনমেন্ট অপশনে রোগী চিকিৎসক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাবেন এবং নতুন করে চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়-তারিখ ঠিক করতে পারবেন। টেস্ট রেজাল্ট অপশনে চিকিৎসকের দেয়া ডাক্তারি পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট সংরক্ষিত হবে। তাই রোগীকে কাগজপত্রের ফাইল হাতে না ঘুরলেও চলবে।
প্রেসক্রিপশন অপশনটি এই অ্যাপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে রোগীর রোগ অনুযায়ী চিকিৎসক ওষুধ খাবার পরামর্শ দেবেন। কোন ওষুধ কখন খেতে হবে এই নির্দেশনা থাকবে। রোগী ওই সময় অনুযায়ী ওষুধ খাবার জন্য গুগল ক্যালেন্ডারে ব্যবহার করে অ্যালার্ম অপশনে গিয়ে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলে অ্যাপ অ্যালার্ম দিয়ে রোগীকে মনে করিয়ে দেবে। প্রতিটি ওষুধের সঙ্গে অ্যালার্ম সেট করার সুযোগ আছে।
ফলোআপ অপশনে রোগী জানতে পারবেন কখন কোন চিকিৎসকের কাছে তাকে যেতে হবে। এখানেও আছে অ্যালার্ম সুবিধা।
২৫ জুলাই মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মিলনায়তনে এই অ্যাপটি উদ্বোধন করা হয়। অ্যাপের উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র আনিসুল হক সমস্যা জর্জরিত দেশে জনগণের সমস্যা সমাধানে আধুনিক প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হৃদরোগে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান বলছে ১৯০ টি দেশে গড়ে ১৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে মারা যায়। হৃদযন্ত্রের রোগীরা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের চিকিৎসা-ওষুধ একটি এদিক-ওদিক হলেই মহাবিপদ হতে পারে। রোগীদের সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা দিতে এমন অ্যাপের প্রয়োজন ছিল। এই ডিজিটাল উপায়ে এখন রোগীরা নিয়ম করে চিকিৎসা, ওষুধের সেবা পাবে। এতে রোগীর সময় সাশ্রয় হবে, কমবে ঝুঁকি। পাশাপাশি রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ বাড়বে।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে নিজের বক্তব্যের শুরুতেই প্রতিমন্ত্রী পলক ইহার্ট অ্যাপের কারিগর কাজী জামিল আজহারের অবদানের কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘এখন স্মার্টফোন দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আজ যখন এই ইহার্ট অ্যাপ উদ্বোধন করলাম তখন মনে হলো জামিল ভাই আমাদেরকে যেনো একটি ডিজিটাল হার্ট উপহার দিলেন। এই অ্যাপ রোগের চিকিৎসা তো বটেই রোগ প্রতিরোধের বার্তা যেনো দিতে পারে এই প্রত্যাশা করছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এখন আমরা স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটাল করায় জোর দিচ্ছি। আমরা গ্রামীণ জনগণের দরজায় স্বাস্থ্য সেবা দিতে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছি। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশব্যাপী এরকম ৩৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরকম অ্যাপ তাই ঢাকা কেন্দ্রীক না রেখে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।’
ইহার্ট অ্যাপ তৈরি করা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টি জামিল আজহার বলেন, ‘দেশের মানুষের কাজে প্রযুক্তিকে আরও বেশি ব্যবহার উপযোগী করতে এ ধরণের গবেষণা অব্যাহত রাখতে চাই। প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা কম। প্রতি ৩ হাজার জনের জন্য মাত্র ১ জন চিকিৎসক আছেন। গ্রামে ১৫-২০ হাজার মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার। তাই প্রচলিতভাবে সনাতনী ব্যবস্থার বদলে আমাদেরকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যেতেই হবে। এই লক্ষ্যে এই অ্যাপটি আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস।’
অ্যাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনএইচএফ এর প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক বিগ্রেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক। অনুষ্ঠান শেষে পারস্পরিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রযুক্তি সহায়তা অব্যাহত রাখতে আইসিটি বিভাগ, এনএইচএফ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।