আমার খুব আদরের এক ছোট ভাই (আপন ভাই না, ক্যাম্পাসের) সম্প্রতি এটম বোমার কাছাকাছি শক্তির এক মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অধিকাংশের যোগ্যতা নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন। বয়সে সামান্য ছোট হলেও, খ্যাতিতে আমার অনেক বড় এই ভাইটি যাদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন আমি তাদের একজন। প্রায় সবাই অত্যন্ত যোগ্য হলেও, যে দুই একজন অযোগ্য শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় জগতে আছেন, আমি তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করি।
আমার খ্যাতিমান এই ভাই লিখেছেন—“চোখের সামনে দেখছি সবচেয়ে মেধাবী কিংবা সবচেয়ে যোগ্যদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তদবিরের জোরে তুলনামূলক অযোগ্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নীতিহীন একটা রাষ্ট্রে এমনটা হতেই পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকরাই যখন মর্যাদা আর নীতির কথা বলে তখন সেটাকে চরম ভণ্ডামি মনে হয়। মাফ করবেন মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ। আর কেউ না জানুক আপনিতো জানেন কোন যোগ্যতায় আপনার নিয়োগ হয়েছে। আর সেটা জানেন বলেই জীবনে আর কোনদিন মেরুদণ্ড সোজা করতে পারেন না। আর সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশই অমেরুদণ্ডী প্রাণী। তবে গুটিকয়েক যাদের মেরুদণ্ড আছে তাদের সালাম, যদিও তাদের সংখ্যা হাতেগোণা।”
আমাকে শিক্ষক হিসেবে নেয়াতে আরও অনেকের কপাল পুড়েছে জেনে আমি যারপরনাই ব্যথিত হয়েছি, কিন্ত আমি তো আর আমার চাকরি জলাঞ্জলি দিয়ে বাকিদের ব্যবস্থা করতে পারি না! যদি পারতাম, আমি হতাম মহামানব! কিন্ত নিজের পরিবার, পরিজন নিয়ে কষ্ট সহে অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর মতো সাহস আমার কেন, অধিকাংশ মানুষেরই নেই। কিছু মানুষের ছিলো, তারা আর জীবিত নেই। যেমন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জাতীয় চার নেতা।
একজন স্বার্থপর মানুষের মতো আমি ব্যক্তিগত যোগ্যতা (?), প্রচেষ্টা (মনে চাইলে তদবিরও বলতে পারেন) এবং অবশ্যই রাজনৈতিক কর্ম স্বচ্ছতার সামাজিক সনদে ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সুবিবেচনায় আরও অনেক যোগ্য প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের চাকরি ‘বাগিয়ে’ নিয়েছি। নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর, অনেকক্ষণ একটা গান মনে আসছিলো—“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না, সন্বন্ধটা এইবার তুমি ভেস্তে দিতে পার, মাকে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না।” আমার ‘বেলা’কেও হয়তো আমি হারাতে চাইনি!
সাংবাদিক থেকে সাংবাদিকতার শিক্ষক হয়ে যাবার পর, এক পরিচিতজন, (আমার ধারণা, সে অযথা আমাকে হিংসা করত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরে প্রশ্ন করেছিল—ভাই আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন? বলেই সে সটকে পড়ল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম, আমাকে অপমান করার জন্য এই প্রশ্নটা করেছিল সে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, অন্য ৮/১০ টা চাকরি থেকে ভিন্ন। সকাল-সন্ধ্যা অফিস করলাম, বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে চাইনিজ খেতে গেলাম, মাস শেষে বেতনের বাইরে অপ্রদর্শনযোগ্য হান্ডস্যাম এমাউন্ট গুনে জীবন আরাম আয়েশে কাটিয়ে দিলাম—এমন জীবন আমাদের না । প্রতিদিন ৩/৪ টা ক্লাস লেকচার (মাঠের ভাষণ নয়, রাতের বেলা পড়তে হয়), ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং করা, পরীক্ষা নেয়া, ফলাফল দেয়া, গবেষণা করা ও করানো, আর্টিকেল লেখা সব মিলে দিনের ঘুমটুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয় আমাদের।
কাগজের ফাইল আর মানুষ প্রস্তুত করা এক জিনিস? আমরা ইতিহাস, নৃতত্ত্ব আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শক্তিতে গড়ে তুলি আগামীর নেতৃত্ব। আমাদের ছেলেমেয়েরাই বাংলাদেশ চালায়। সামান্য বেতনে চলতে হলেও আমরা নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের কর্মঠ যোদ্ধা হিসেবে। আমাদের ভুলে ধবংস হতে পারে একটি প্রজন্ম, একটি সভ্যতা। এমন স্পর্শকাতর কাজ করে একটি দেশের প্রশাসন এবং উৎপাদনযন্ত্রকে যারা চলমান রেখেছেন তাদের অধিকাংশকে অযোগ্য বলে অতিসাধারণীকরণ মন্তব্য করা কোনো শিক্ষিত মানুষের উচিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। নূন্যতম একাডেমিক যোগ্যতার শর্ত উল্লেখ থাকে সেখানে। যারা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যোগ্য, তারা সবাই আবেদন করেন। আবেদনকারীদের ভেতর নানা কিসিমের মানুষ থাকেন। কারো খুব ভাল রেজাল্ট, কিন্ত গবেষণা নিবন্ধ নেই, কোথাও কাজের অভিজ্ঞতা নেই। আবার অনেকে থাকেন যাদের রেজাল্ট সবচেয়ে ভাল হয়তো না, কিন্ত প্রকাশনায় অনেক ভালো, পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতাও বেশ ভালো। অনেকে আছেন যারা সরাসরি শিবির, হিজবুত তাহরির করে। অনেকে আছেন, যাদের সমাজ, রাজনীতি, বাস্তবতা নিয়ে নূন্যতম ধারনা নেই। এত কিসিমের মানুষের মধ্যে আপনি কাকে নিবেন, আপনিই বলুন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমালোচনা করার অনেক কিছু থাকতে পারে। তাই বলে অধিকাংশ শিক্ষককে “অযোগ্য” বলা কোনোভাবেই যৌক্তিক মন্তব্য হতে পারে না। মুশকিল হলো, আমরা শুধু নিজেকে যোগ্য মনে করি, আর বাকিদের অনাকাঙ্ক্ষিত উপদেশ দিয়ে বেড়াই। সবাই একটু যার যার পেশার মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেন, কে কোন যোগ্যতা নিয়ে কাজ করছেন? অনেকেই করবেন না, কারণ এতে থলের বেড়াল বের হয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)