প্রখ্যাত অধ্যাপক আহমদ শরীফের লেখনির মাধ্যমে জানা যায় ‘২১শে ফেব্রুয়ারির গৌরবের রোমন্থন, না সমকালীন সংকটে-সমস্যায় ২১শের সংগ্রামের অনুসরণ? বা কর্তব্য কি? ২১ শে গৌরবের রোমন্থন, না সংগ্রামের অনুসরণ?’ তিনি তার নিয়মিত ডায়েরিতে এ বক্তব্যটি লিখে মূলত আমাদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। আমার মতে, প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই সংগ্রামের অনুসরণ হওয়া উচিত। শুধু কি অনুসরণেই সীমাবদ্ধ, বরঞ্চ একুশের সংগ্রামের চেতনাকে মূলনীতি ধরে সমকালিন সংকট সমস্যায় নতুন প্রজন্মের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, পরিবর্তন এবং উজ্জ্বল্যের ভারসাম্যে প্রত্যেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জনের সাথে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল এবং এখনো রয়েছে। সভামঞ্চে, পথসভায় বা টকশোতে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবহুল স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। অনেক চেতনাধারী বুদ্ধিজীবীরা টকশোতে গলা ফাটিয়ে চেতনার বহি:প্রকাশ দেখানোর চেষ্টা করেন কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটা হয়। তাই বুদ্ধিজীবীরা এখন আর সকলের সমীহ পায় না অথচ একটা সময় আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন।
কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ভাষার মাসে ১৯৫২ সালের আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় কোন সমস্যা সমাধান করতে পারছি না। তাহলে কি সংগ্রামের অনুসরণ হলো? যদি আমরা সংগ্রামের অনুসরণ করতে না পারি তাহলে সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় কোন জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। আর সেটি জাতির জন্য অত্যন্ত হতাশার এবং বিষাদের। ভাষার মাসে আরও যেন কটাক্ষ বেড়ে যায় ভাষার প্রতি। মাসের শুরুতেই অনেকেই ভিন্ন ভাষার সংগীত চর্চাকরণের মাধ্যমে পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠান করে থাকে। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিল বোর্ড টানানোর ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে এবং পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। প্রকৃতঅর্থে, এ রকম জাতিগত বিষয়গুলো আত্নিক সম্পর্কের ন্যায় হয়ে থাকে। কখনো জোর করে কিংবা আইনের আশ্রয় নিয়ে অন্যের উপর প্রয়োগ করার বিষয় নয়। দেশপ্রেম মূলত আত্নস্থ ও রপ্ত করার কৌশলের মাধ্যমে বজায় থাকে। আর এর জন্য ভাষাভিত্তিক ও ঐতিহ্যভিত্তিক চেতনাকে লালন করার জন্য চর্চা করতে হবে। চর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিবারই মূলত মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার থেকেই শিশুদেরকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশপ্রেমের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলতে হবে।
একুশের চেতনা বলতে আমরা কি বুঝি? একুশের চেতনা বলতে স্বাভাবিকভাবে বোঝায়, বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জন্য তাৎপর্যার্মন্ডিত ও বাঙালির অধিকার সমুন্নত রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি কর্তৃক গৃহীত ও মনোবাসিত কর্মপদ্ধতিকেই বুঝানো হয়ে থাকে। যে চেতনায় বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত সম্পর্কের ইতিবাচকতাকেই বোঝানো হয়ে থাকে তথা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে গঠনমূলক ও পরিবর্তনশীল পরিবর্তন প্রাধান্য পায়। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বলতে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নকে বুঝানো হয়। একশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন কখনোই একুশের চেতনার ধারক নয় কিন্তু আমাদের সমাজে বৈষম্য স্পষ্ট। কিছু মানুষের কাছে দেশের সম্পদের একটা বিরাট অংশ পড়ে রয়েছে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই বিভ্ন্নিভাবে শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে। বিষয়টি একুশের চেতনার পরিপন্থী এবং ভাষা সংগ্রামীদের জন্য অবমাননাকর।
দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক উন্নয়ন তথা রাজনৈতিক মূল্যবোধের বিকাশকে একুশের চেতনার ধারক বাহক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কারণ, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ন্যাক্কারজনক রাজনীতির কারণে আমাদেরকে ভাষার জন্য আত্নাহুতি দিতে হয়েছিল। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে হবে মৌলিক মূল্যবোধসম্পন্ন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার খুব বেশি একটা দেখা যায় না প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক সম্মেলন হলে সেখানে সম্মেলনের বিষয়বস্তু ভুলে রাজনৈতিক নেতারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করার পায়তারায় মত্ত থাকে। সুতরাং একুশের চেতনার বাস্তবায়ন হচ্ছে না রাজনৈতিক ময়দানে। শেষত: পেশাগত বৈচিত্রতায় লক্ষ্য করা যায়, আর্থিক অসামঞ্জ্যতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে পেশাগত বৈচিত্র্যতায়। প্রত্যেকটা পেশাই যে গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অন্যকে সম্মানের সহিত সম্বোদন করা উচিত সে বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুলে যাই। উচ্চশিক্ষিতরা কম যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাধারীকে মূল্যায়ন করতে হীনমন্যতায় ভোগে থাকেন যা স্পষ্টতই একুশের চেতনার পরিপন্থী।
বাংলা ভাষা আন্দোলন যে কয়েকটি মূলনীতিকে সামনে রেখে পরিচালিত হয়েছিল সে সবগুলো এখনো আমরা তথা রাষ্ট্রিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি কিনা সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা কোথাও হয় না। পদে পদে ভাষার অপব্যবহার যেমন সামাজিকভাবে হচ্ছে কিংবা আমরা করছি ঠিক সেভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষার অপব্যবহার বন্ধে তেমন কোন কঠোর পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। যদি থাকতো তাহলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যেভাবে বাংলাকে লাঞ্জিত করা হয় সেটা ভাষা শহীদদের অপমান করার শামিল। মুখে মুখে একুশের চেতনার কথা বললেও কার্যত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা বেমালুম সব কিছু ভুলে যাই। ভুলে যাই কিভাবে আমরা ভাষাটি পেয়েছি এবং এর পিছনে শতশত মানুষের ত্যাগ ও তীতিক্ষার অবদান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যে চারটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয় সেগুলো হল: ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ২. রাজবন্দীদের মুক্তি চাই ৩. শহীদ স্মৃতি অমর হোক ৪. সর্বস্তরে বাংলা চালু হোক। এর মধ্যে প্রথমটি যথাযথভাবে অর্জিত হয়েছে এবং এখনো বলবৎ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিতীয়টি কি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিকভাবে শত শত মানুষ হয়রানির শিকার হয়। আমরা কি পেরেছি রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধ করতে, পারিনি বন্ধ করতে যা একুশের চেতনা বাস্তবায়নের অন্তরায়। তৃতীয়টিও আমরা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। কারণ, শহীদদেরকে যেভাবে মর্যাদা দেওয়া উচিত আমরা সেভাবে দিতে পারছি না। যেমনটা এখনো পারিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করতে। উদ্ধার করতে পারিনি সব বধ্যভূমি। এসব কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বেদনার এবং বিষাদের। চতুর্থটি সর্বস্তরে বাংলা চালুকরণের যে দাবি ১৯৫২ সালে ভাষা সংগ্রামীরা করেছিলেন সেটা আদৌ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা প্রত্যেক বিবেকবান পাঠকের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। উল্লেখ্য যে, বিকৃত ভাষা ব্যবহার কখনোই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বীকৃতি হতে পারে না। এমনো দেখা যায় কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ ইংরেজি নামে হয়েছে। যা একুশের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং বিষয়টি ভবিষ্যৎ ভাষা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মারত্নক হুমকিস্বরূপ।
প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নানামুখী চিন্তা চেতনা মনে উঁকি দেয়। ইংরেজি শিক্ষা বা ইংরেজি ভার্সনে লেখাপড়া শেখানোর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যে আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় সেভাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বিদেশী ভাষা শেখার দরকার নেই সেটা বলছি না, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য ইংরেজির কোন বিকল্প নেই। তাই বলে নিজের ভাষাকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করে নয়। পাশাপাশি আমাদের যে আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি কোন উদ্যোগ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টা বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িতদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কারণ, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য ভাষা সংগ্রামীরা জীবন দিয়েছেন তাদের সে উদ্দেশ্য দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
একুশের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। নতুন প্রজন্মের সেনানিরা একুশের চেতনার মূলনীতিকে ভিত্তি ধরে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য গণআন্দোলন গড়ে তুলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একুশের চেতনার সংস্কৃতি গড়ে তোলার মহৎ উদ্যোগের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা যাবে। শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চা ও এর যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের আত্নত্যাগের মূল্যায়ন করা হবে এবং সেটিই হবে নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভাষার মাসে সকল ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)