অভিনয় যেন ছিল তার পুরোটা জীবন। তিনি নিজেই বলতেন ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছু পারিনা আমি।’ অভিনয়ের অতল ভুবনের বহুমাত্রিক ঘাত প্রতিঘাত থাকে। তেমনই ঘাত প্রতিঘাতের দোলাচলে আচমকা প্রস্থান। বড় নিঃসঙ্গ অবস্থায়।
জুরি বোর্ড কর্মকর্তা বাবার বদলির চাকরির সুবাদে তাকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। ফলে দেখেছেন অনেক চরিত্র। মিশেছেন অনেক চরিত্রের সঙ্গে। তার কৌতুকবোধ তার অভিনয়ে সেই দেখার নির্যাস মিলেছে সবসময়।
অথচ অনেক কিছু করতে পারতেন তিনি। হতেও পারতেন অনেক কিছু পুরান ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেওয়া ছেলেটি। কিন্তু ‘কীর্তণখোলা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘ফণিমণসা’ কিংবা ‘ধুর্ত উই’ যার মাঝে বাসা বাঁধে তার অভিনেতা হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নে ১৯৭০ সালে ভর্তি হয়েও যে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় তার ‘একাত্তরের যীশু’ হওয়া ছাড়া কোন পথ খোলা থাকেনা।
স্বাধীন দেশে ফিরে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঢ় সবুজের মাঝে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি, স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেও যে ‘ভূত’ নিয়ে নাড়াচাড়া করে, ঢাকা থিয়েটারের নির্দেশনায় আসে-তার অভিনয় শিল্পের অন্দরে প্রবেশ করা ছাড়া আর কিবা করার ছিল!
এই যে ‘ভূত’ তার মাথায় ঢুকেছিল তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নামেনি। যে ভূত তার ভেতরে অবচেতনেই গেঁথে দিয়েছিলেন ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ কারিগর সেলিম আল দীন। ১৯৭৬ সালে তার উৎসাহে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেয়া এবং প্রায় একা হাতে উৎসব সফল করে দওয়া যে অদ্ভুত আবেগী শিল্পী প্রাণ, তা ৩৬ বছর ধরে অভিনয় শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমকে বর্ণিল এবং সমৃদ্ধ করে গেছে। অনেক সময় তাকে হয়ত ব্যবহার করতে পারেনি শিল্পের কারিগররা কিংবা তিনি হয়তো ব্যবহৃত হতে চাননি। কেবলই অর্থনৈতিক পাল্লায় ফেলে দিয়েছেন নিজেকে ন্যুনতম যাচাই বাছাই না করেই।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূমিকা অসামান্য। এর মূল সঞ্চালক ছিলেন কয়েকজন নাট্য ব্যক্তিত্ব, তাঁরা হলেন সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, পিযূষ বন্দোপাধ্যায়, সুবর্ণা মোস্তফা এবং যাকে নিয়ে শুরুর এত কথা সেই বন্ধু অন্তপ্রাণ হুমায়ুন ফরীদি।
ছোটখাট মানুষটি অভিনয় উচ্চতা দিয়ে রুপায়িত চরিত্রকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতেন তার তুলনা নেই। টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মধ্য দিয়ে। এরপর নীল নকশার সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), বকুলপুর কতো দূর (১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৬), সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৬), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), চাঁন মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ (১৯৮৬), ওযাত্রা (১৯৮৭), সংসপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), দুই ভাই (১৯৯০), শীতের পাখি (১৯৯১), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), সমুদ্রের গাঙচিল (১৯৯৩), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬), মোহনা (২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), শৃংখল (২০১০), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), আরমান ভাই দি জেন্টলম্যান (২০১১) ইত্যাদি নাটকে সফল অভিনয় করেন।
‘সংশপ্তক’ এর ভয়াল কানকাটা রমজান বা ‘কোথাও কেউ নেই’ এর আকারে ছোট উকিল চরিত্রটির তুলনা করলে বোঝা যায় তার অভনয়ের ব্যাপ্তি। রমজানের ‘আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ কিংবা ‘দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান’ অথবা উকিলের ‘ওহ, গড সেভ মি। শো মি দ্য ওয়ে’ এখনও কানে বাজে। সেই গভীরতার ছাপ চলচ্চিত্রে টেনে নিয়ে এসে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অনেক ধারণাকে বদলে দিয়েছিলেন। খলচরিত্রও যে একটি চলচ্চিত্রের প্রাণ হয়ে উঠতে পারে নান্দনিকতা কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্যে তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি প্রতি পদে পদে। যদিও কখনও কখনও প্রশ্ন উঠেছে তার মত শিল্পী কি তার নিজের প্রতি সুবিচার করছেন? কিন্তু এর বিপরীতেও কথা হয়েছে, তার মত শিল্পীকে সুবিচার করার মত পাটাতন কি আমরা দিতে পেরেছি?
তিনি বলেই সম্ভব হয়েছে ‘হুলিয়া’, ‘দহন’, ‘ব্যাচেলর’, ‘আহা’, ‘মাতৃত্ব’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ কিংবা ‘একাত্তরের যিশু’র মত সিনেমা করেও ‘রাঙ্গা বউ’, ‘সন্ত্রাস’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘ভণ্ড’, ‘রিটার্ন টিকেট’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ প্রভৃতি সিনেমার মত পুরোদস্তর বাণিজ্যিক ঘরাণার সিনেমা করা। ‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
ভাষা আন্দালনের বছর ১৯৫২ সালের আজকের দিন ২৯ মে জন্ম নিয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। বাবা এ টি এম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। তিনি নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মাদারীপুর সরকারি ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৬৮ সালে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করেন। হুমায়ুন ফরীদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন পাঠদান করেন।
হুমায়ুন ফরীদির প্রিয় একটি উক্তি ছিল ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’। কিন্তু ছোটবেলায় ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’ বা ‘গৌতম’ নামে অভিহীত ‘একাত্তরের যীশু নিজের জীবনেই কেন যেন এই সূত্র মেনে চলেননি। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর ঢাকার বাসায় মারা যান। বড় বেশি নিঃসঙ্গতায়। যা হওয়ার কথা হয়ত ছিলনা।
স্বাধীনতার পর সহপাঠীর বোন নাজমুন আরা বেগম মিনুকে বেলী ফুলের মালা পরে বিয়ে করেছিলেন ফরীদি। অনিবার্য বাস্তবতায় দেবযানীর আলোময় সে সংসার। দেবযানী হুমায়ুন ফরীদির একমাত্র কন্যা। পরে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে দ্বিতীয় সংসার জীবন। কিন্তু এখানেও বিচ্ছেদের ধাক্কা হয়ত মনে শরীরে বহন করতে পারেননি ব্যক্তিজীবনের অসম্ভব অভিমানী ‘চন্দ্রগ্রস্ত’ ফরীদি। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন সবকিছু থেকে। মাঝে মাঝে দুয়েকটি নাটকে অভিনয় ছাড়া সারাদিন বাসাতেই কাটতো এই চির আড্ডাবাজ ‘বিশ্বপ্রেমিক’ এর।
৬৭ তম জন্মদিনে ‘একাত্তরের যীশু’, আপনাকে মনে পড়ছে খুব।