২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশাল পাওয়া আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ। পূর্বে যা ছিল প্রাদেশিক। এখন তা জাতীয়। রাষ্ট্রে প্রধান বিচারালয় প্রান্তর। দু’জন বিচারপতি যৌথ সম্মতিতে একটি রায় দিলেন। যার গূঢ়ার্থ: ওরা ছিল, ওরা আছে, ওরা থাকবে।
কে এই ‘ওরা’! স্বাধীন ভূমির আকাঙ্ক্ষায় প্রবলভাবে জেগে ওঠা মানুষকে দাবিয়ে দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীর অন্যতম হিংস্র ও বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে ভয়ঙ্কর গণহত্যা শুরু করে। ওদের হিসাব ছিল বাঙালি সামরিকভাবে নিরক্ষর জাতি। কিন্তু ওরা হিসাব করেনি, এর আগে ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় ইতিহাসকণ্ঠ বজ্রস্বরে ঘোষণা করেছিলেন: “সাত কোটি বাঙালিকে তোমরা ‘দাবায়া’ রাখতে পারবা না।”
তখন শুধু আওয়ামীপন্থি নয়, বাঙালিদের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নির্বিশেষে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই ভয়ঙ্কর পাকিস্তানি দানবের বিরুদ্ধে। মাত্র ১৫-২০ দিনের সামরিক প্রাথমিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে প্রগাঢ় দেশপ্রেম আর বেপরোয়া সাহস যুক্ত হলে কী রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, তা যাদের দেখার সুযোগ হয়নি, তারা মানবজাতির এক অসাধারণ ঐশ্বর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একাত্তরের বাংলাদেশে প্রকাশ্য ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়ন আর অপ্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টির হাজার হাজার কর্মী ষাটের দশকের সব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নদী বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল মোহনায় আবর্তিত হতে থাকল সাহস ও আত্মদানের অজস্র গল্প গড়ে।
বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের প্রথম কয়েক বছরের উথালপাথাল, এলোমেলো বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু সরকার যখন সবকিছু গোছাতে প্রাণান্ত হচ্ছিল, তখনই তাঁকে সপরিবারে বধ করল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দেশ-বিদেশের অপশক্তি। তার পরের ঘটনা তো আমরা জানি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস চূর্ণবিচূর্ণ। একসময়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সামান্য সুবাতাস। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্তির অপূর্ণ কাজ নবউদ্যমে শুরু হতে না হতেই ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দানবরা মন্ত্রিত্বের গাড়িতে পতাকা উড়াবার স্পর্ধা দেখায়। অনেক ঘটনার পর ২০০৮ সালে পুনরায় বঙ্গবন্ধুকন্যার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান।
পূর্বপ্রস্তুতির সূত্র ধরে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেন-দরবার-উদ্যোগী প্রচেষ্টার ধারায় বিশেষ গেরিলা বাহিনীর তালিকা নবপর্যায়ে সম্পন্ন হলো। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তা অনুমোদন করল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি তা গেজেট হিসেবে প্রকাশ করল। অনেক প্রচেষ্টা আর সংগ্রামের শেষে এমন ফলাফলে বিলম্ব হলেও আমরা হাজার হাজার একাত্তরের গেরিলা মানসিকভাবে শক্তি পেলাম। উৎসাহিত হলাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রণোদনায়। আমাদের অনেকেই গেজেটভুক্তির সুবাদে সনদ গ্রহণ এবং ভাতাপ্রাপ্তির সুযোগ পেল।
এদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক ধারা বজায় বনাম নির্বাচন ভণ্ডুলের মারাত্মক লড়াইয়ে ভণ্ডুলকারীরা পরাজিত হলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব সরকারে মুক্তিযুদ্ধবষয়ক মন্ত্রী বদল হলো। নতুন মন্ত্রী হঠাৎ জানাল, আমাদের গেজেটভুক্ত সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। অনেক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনার মধ্যেও আমরা একাত্তরের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সাতজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করলাম ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবরের সময়সীমার মধ্যেই। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের একান্ত আলোচনা হলো। আমাদের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রত্যয়নকৃত গেজেটভুক্ত সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ-সুবিধাদানে মন্ত্রী সম্মত হলেন। এদিকে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ প্রবচনটি সত্য প্রমাণ করতেই বুঝিবা গাজীপুর উদ্ভূত মন্ত্রী ‘গাজী গাজী’ করেই ২৩৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধার গেজেটখানি হঠাৎ বাতিল করে দিলেন।
সেই থেকে শুরু হলো নতুন এক আইনি যুদ্ধের পর্ব। আমাদের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রবীণ নেতা পংকজ ভট্টাচার্য এই আইনি যুদ্ধে গ্রহণ করলেন প্রধান উদ্যোক্তার ভূমিকা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সাত সদস্যের স্বাক্ষরে চলল বাহিনীর প্রত্যয়নকৃত তালিকা। পূর্বতন ২৩৬৭ জনের তালিকায় ছিল না প্রবীণ নেতৃবৃন্দ বারীন দত্ত, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, রবি নিয়োগী, বেতিয়ার যুদ্ধের শহীদবৃন্দসহ অনেকের নাম। প্রত্যয়নকৃত তালিকায় এভাবে যুক্ত হলো বাদ পড়ে যাওয়া অনেকের নাম।
একদিকে আইনি যুদ্ধ। আইনি লড়াকুদের আইনজীবী হিসেবে অ্যাডভোকেট জাহিদুল বারীর সঙ্গে একান্ত পরামর্শক্রমে আমরা মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র সংগ্রহ করে মামলার সপক্ষ যুক্তিকে শক্তিশালী করে তুললাম। প্রত্যয়নের নব কার্যক্রমে বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টি এবং মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে মাসের পর মাস চলল অভাবনীয় শ্রমের কাজ। অবশেষে আমাদের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আবদুস সবুর, তবারক হোসেইন এবং মূল সমন্বয়কারী আইনজীবী জাহিদুল বারীর নেতৃত্বে আইনি যুদ্ধের নানা পর্ব পেরিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর আমরা পেলাম ঐতিহাসিক রায়। যে আইনি যুদ্ধের এক প্রকার জনপরিচিতি দাঁড়াল ‘পংকজদার মামলা’।
আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, একজন বীর প্রতীক মমিনুল্লাহ পাটওয়ারীকে। ১৯৯৭ সালে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রশাসনিক মহাপরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। একদিন তার কার্যালয়ে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধর্ষ ন্যাভাল কমান্ডো। তিনি তাদের বাহিনীর নাম তালিকাভুক্তির পুস্তক আমাকে দেখালেন। আমি তখন স্বভাবসুলভ উন্নাসিকতায় বললাম, আমরা যুদ্ধ করেছি কিছু পাওয়ার জন্য নয়, জীবন দিতে গিয়েছি, বিনিময়ে কিছু পেতে চাই না। জনাব পাটওয়ারী আমাকে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, আপনাদের ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত বাহিনী ইতিহাসের একটি অংশ। আপনি সনদের সুযোগ নিন বা না নিন, আপনার বাহিনীকে ইতিহাসচ্যুত করার কোনো অধিকার আপনার নেই। আপনারা অনতিবিলম্বে তালিকা পেশ করুন।
আমার চিন্তাধারা একটা বড় ধাক্কা খেল। ঠিকই তো, আমার বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ইতিহাসভুক্ত করার সংগ্রাম নবপর্যায়ে শুরু করতেই হবে। কমিউনিস্ট পার্টির আর্কাইভের দায়িত্বে ছিলেন শেখর দত্ত, তিনি মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের তখন সম্পাদক। শেখর দত্ত বললেন, আর্কাইভের দায়িত্ব তো শেষ পর্যায়ে ছিল ওসমান গণি ভাইয়ের কাছে। তিনি তো বেঁচে নেই। এখন কী করি! এর কয়েকদিন পরই শেখর দত্ত টেলিফোন করে বললেন, পেয়েছি, পেয়েছি, কিছু দলিল-ছবি পেয়েছি। শেখর দত্ত গেলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছে। তারপর এক সন্ধ্যায় মনজুরুল আহসান খানের বাসভবনে শেখরদা এবং আমি গেলাম একসঙ্গে। আমাদের বাহিনীর তালিকা শুরু করতে হবে নবউদ্যোগে।
এরপর শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। ট্রাস্ট অফিসকে কেন্দ্র করে সারাদেশে তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হলো সমন্বিতভাবে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদে তালিকা পেশ হলো ১৯৯৮-৯৯-এর দিকে। কিছু লাল মুক্তিবার্তায়, কিছু সবুজ মুক্তিবার্তায় নাম ছাপা হতে না হতেই শেখ হাসিনা সরকারের সময় শেষ হয়ে গেল। তারপর তো চারদলীয় জোট সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অধ্যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সব আমলেই সব সুযোগেই নানা ফাঁকফোকরে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ২০০১-০৬ খালেদা আমলে তা করা হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনায়। আর ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর একাত্তরের ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর গেজেট বাতিলের ষড়যন্ত্রও ছিল বিশেষভাবে পরিকল্পিত। এটা অনুমিত, প্রশাসনের ঘাপটি মেরে থাকা নব্য সরকারি তাঁবেদার সাজা জামায়াতি আমলারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে প্রভাবিত করে এই ষড়যন্ত্র সফল করেছে। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আমাদের সর্বোচ্চ আদালত যা আইনিভাবে ভণ্ডুল করে দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও সম্মান-স্বীকৃতি উজ্জ্বলতর করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগ এবং ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই মহান প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভণ্ডুলকারীরা শেখ হাসিনা সরকারের গভীরেই ‘খন্দকার মোশতাক’ হয়ে অবস্থান করছে।
ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ বাহিনীর বেঁচে থাকা প্রবীণ নেতৃত্বকে অনুরোধ করছি, এই ঘাপটি মেরে থাকা ‘খন্দকার মোশতাক’দের প্রশাসনসহ অন্যবিধ স্থান থেকে বিদূরিত করার জন্য শেখ হাসিনাকে সতর্ক ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করুন। জাতীয়ভাবে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ। আর ২৩৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সপক্ষে ঘোষিত সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে বাস্তবে অকার্যকর করার সম্ভাব্য ‘আমলা-অপকৌশল’ সম্পর্কেও সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে অষ্টপ্রহর। মুক্তিযুদ্ধ ছিল, আছে, থাকবে। বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অবদানও ছিল, আছে, থাকবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)