একটি হুইল চেয়ার। তাতে বসা এডি বারলো নামের এক ভদ্রলোক। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। প্রায় দেড় যুগ আগের এই দৃশ্যটা এদেশের বয়সী কোনো ক্রিকেটভক্তের চোখে লেগে থাকার কথা। শততম টেস্টের আগে নিশ্চয়ই তার মনে পড়ার কথা বারলো নামের ওই লোকটাকে।
বারলো ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে আসেন। টেস্ট মর্যাদা পেতে চলা একটা দলের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই কোচ এখন আর বেঁচে নেই। যতদিন পৃথিবীতে ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জয়গান গেয়ে গেছেন। ঐতিহাসিক প্রথম টেস্টের আগে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ওই অবস্থায়ই মাঠে এসেছিলেন।
বারলো সেদিন তার শিষ্যদের পরাক্রম দেখেছিলেন। দেখেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলির বিপক্ষে নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের টস জয়। দেখেছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল নামের এক যুবকের সেঞ্চুরি।
বাংলাদেশ আগে ব্যাট করে ১৫৩.৩ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ৪০০ রান সংগ্রহ করেছিল। অজিত আগারকারের বলে শ্রীনাথের হাতে ক্যাচ দেয়ার আগে বুলবুল ১৪৫ রান করেন। তিনি ছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় ক্রিকেটার, যিনি তার দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন। আমিনুলের ৫৩৫ মিনিটের দীর্ঘ এই ইনিংসে ছিল ১৭টি চারের মার। বল খেলেছিলেন ৩৮০টি। সঙ্গে হাবিবুল বাশার খেলেছিলেন ৭১ রানের কার্যকরী ইনিংস। এটিই ছিল ম্যাচের প্রথম ফিফটি। অভিষেক টেস্টে ১৫৭ মিনিট ব্যাট করে ১০ চারে ১১২ বল খেলে তিনি এই রান করেন। মাঝে আকরাম খান ৩৫ করে যান। শেষ দিকে খালেদ মাসুদ পাইলট ৩২ রান করেন। অঙ্কের হিসেবে এই রান তেমন কিছু নয়। কিন্তু সেদিনের পরিস্থিতি বিবেচনায় ছিল সঞ্জীবনী সুধা। পাইলট ওই কটি রান করতে ১৬৯ মিনিট ক্রিজে থাকেন। বল খেলেন ১২১টি।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ সেদিন এত রান করতে পারবে, তা নিজেদেরই কল্পনাতে ছিল না! হাবিবুল বাশার প্রথম অর্ধশতক করেই মূলত অন্যদের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত করেন। অমন শুরুর পর কেউ কেউ জয়েরও স্বপ্ন দেখতে থাকেন!
ভারত জবাব দিতে নেমে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৪২৯ রান করে। ১৯০ রান পর্যন্ত ৫ উইকেট চলে গিয়েছিল সৌরভদের। অধিনায়ক সৌরভ নিজে ৮৪ রান করেন। শেষদিকে সুনীল যোশী সব এলোমেলো করে দেন। ১৮০ বলে ৯২ রান করে ভারতকে লিডের পথে নিয়ে যান।
অধিনায়ক নাঈমুর রহমান তার অফ স্পিনে শিকার করেছিলেন ৬ উইকেট। ৪৪.৩ ওভার বল করে নাঈমুর ১৩২ রান দিয়েছিলেন। ওভারপ্রতি তার রান খরচের গড় ছিল ২.৯৬।
২৯ রানের লিড মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে খেই হারায় বাংলাদেশ। মাত্র ৪৬.৩ ওভার ব্যাট করে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রান ওঠে ৯১। সবচেয়ে বেশি বল খেলেছিলেন খালেদ মাসুদ। ৬৮ বলে ২১ রান করেন। বাশার ৬৩ বলে ৩০ করতে পেরেছিলেন। আর কেউ সাতের বেশি করতে ব্যর্থ হন! ভারত চারদিনে ৯ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়। নতুন পথে যাত্রা শুরু হয় লাল-সবুজ ক্রিকেটের।
ঐতিহাসিক ওই পথে যে ভিত্তি গড়া হয়, সেটি বারলোরই গড়ে দেওয়া। সস্ত্রীক বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ দেশের সবকিছুই দারুণ আপন করে নিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে ২০০১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। যাওয়ার সময় বিসিবির তখনকার অফিসে কান্নায় ভেঙে পড়েন পেশাদার এই মানুষটি। দেশে ফিরে ২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি পরলোকে চলে যান।
তার স্ত্রী ক্যালি বারলো গত এশিয়া কাপের সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন। ফাইনালের পর সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বামীর স্মৃতিচারণ করেন, ‘স্বামীর সঙ্গে এই দেশটাতে এসেছিলাম। এদেশের ক্রিকেট আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল।’
‘এবারের এশিয়া কাপে ফাইনালে খেলল বাংলাদেশ। আমার স্বামী বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন। তিনি নিশ্চয়ই স্বর্গ থেকে খেলা দেখেন আর বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান প্রজন্মকে শুভকামনা জানান,’ কথা বলতে বলতে ক্যালি বারলো চোখের জল আড়াল করেন। এই দৃশ্য যেন ১৬ বছর আগের পত্রিকার একটা ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিলো।
-এডি বারলো বিসিবির অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কাঁদছেন। সঙ্গে থাকা এক সহধর্মিণী চোখে হাত দিয়ে জল আড়াল করছেন। আর নিঃসঙ্গ পড়ে থাকছে একটি হুইল চেয়ার!