বছরে অন্তত তিনবার সে ফুলবতী হয়। ফুলের গন্ধে আমরা মাতোয়ারা থাকি। উদাস হয়ে যাই। একটু দুরে একটি তালগাছ। তারও আছে এক সম্মোহনী শক্তি। আছে ঘন এক কাঁঠাল গাছের জমাট ছায়া। আম জাম জামরুলের মায়াময় এক কানন। শিল্পবাণিজ্যের বাড় বাড়ন্তি উচ্ছ্বাসের ভেতর একটি মায়াবি উঠোন। একদিন এটিই নিজস্ব বাড়ি হয়ে উঠেছিল সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের। এখানে দাঁড়িয়ে একদিন হৃদয় খুলে বাংলাদেশকে দেখেছেন অমর্ত্য সেন।
প্রতিদিন এখানে সেখানে মাকড়োসার সুক্ষ্ণ জালের মতো নকশায় মিলে যায় স্বপ্নের বুনন। সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে এই উঠোনে। সারি সারি স্বপ্ন দ্রুতলয়ে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়, এই উঠোনের ছায়ায়। জীবনের গল্প এখানে রচিত হয়। হাসতে হাসতে। উঠোনের একপাশে সিঁড়ি। ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়িতে বসে থাকেন ফরিদুর রেজা সাগর। এই উঠোনের গৃহস্থ। ভূট্টোর খৈ এর মতো স্বপ্ন ফোটে তার।
পার্বনে তারার ঝাঁক বসে এখানে । এই উঠোন হয়ে ওঠে এক আয়না। সে আয়নায় মুখ দেখে সবাই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নক্ষত্রমালা। উঠোনে পা রেখে বহুবার নিজ ভিটায় প্রাণ খুলে দাঁড়ানোর স্বাদ নিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। বহু পার্বনের এই উঠোনে রবীন্দ্রনাথ মূর্ত হয়ে ওঠেন। নজরুল প্রেম আর দ্রোহ নিয়ে জাগেন বারবার, জাগান বহু মানুষকে।
পয়লা অক্টোবর ধরে ফেলে শরৎ। নগরের তেজগাঁও হয়তো ছড়ায় সোনালী রোদের তেজ, কিংবা মেঘমিষ্টি দিন। সকালে ৪০ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরনীতে বেজে ওঠে বহু মানুষের স্পন্দনের মতো এক সুর। সাবিনা ইয়াসমিন গাইছেন “একটি স্বপ্ন , একটি শপথ/ সেই থেকে পথচলা/ সবার চেয়ে দেশ বড় সেই কথাটিই বলা/ চ্যানেল আই এর আজ জন্মদিন….।” এ যুগের রঙিন বর্ণচ্ছটা, আলোকমালা আর দ্রুত নির্মিত অবাক মঞ্চে এসে কে দাঁড়াননি। যাদের বুকে থাকে ৫৫ হাজার ৫শত ৯৮ বর্গমাইল, তারা সবাই। যাদের চোখে থাকে বাংলা বর্ণমালার মায়া, তারা সবাই। যারা মুক্তি সংগ্রামকে জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় ধরে পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে উঁচু করে রাখেন মাথা, তারা সবাই। যেন বহু মানুষের জন্মক্ষণ। যেন বহু প্রাণের জয়গান এই জন্মদিন।
মঞ্চে থেকে সূচনা রঙিন একটি দিনের। তারপর দিনের বর্ণচ্ছটা চোখে মুখে পৌঁছে যায় ছয়টি মহাদেশে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহর উপশহর গ্রামে। প্রতিটি আলোকপুঞ্জে। প্রতিটি সম্ভাবনার শাখা প্রশাখায়। দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা গাইতে থাকেন জনপ্রিয় সব গান। চ্যানেল আই এর ঘরের শিল্পীও আছে এক ঝাঁক। গাইতে থাকেন তারাও। কখনো দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে একঝাঁক কৃষক এসে মঞ্চে উঠে পড়েন। বলেন, চ্যানেল আই কৃষক, শ্রমিক গরীব দুখির ভাগ্য পরিবর্তনের এক অনন্য নিয়ামক।
সারাটি দিন সন্দেশ বাতাসা। সারাটি দিন খৈ মুড়কি। সারাটি দিন ফুলের তোড়া। ফুলের ডালি। সারাটি দিন শুভেচ্ছা মালা। সবাই আছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ এই শুভেচ্ছার পসরাগুলো হাসি মুখে গ্রহণ করছেন ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ। কখনো আব্দুর রশীদ মজুমদার, মুকিত মজুমদার বাবু, জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুনসহ পরিচালকবৃন্দ একসাথে দাঁড়িয়ে দেশের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠানকে জানাচ্ছেন সম্ভাষণ।
সারাটি দিন খোলা গলায় “তুমি আমার অনেক কিছু, আমরা অনেক ভালোবাসি”। এসব কথা ব্যক্তিকে নয়। শুধুই চ্যানেল আইকে।
এই আয়োজন কোথাও নেই। এ যেন এক বাঁশির সুরে সব হয়ে যায়। কেউ একজন বাঁশি বাজান। কেউ একজন সবটা সাজান। চ্যানেল আই ই এদেশে গণমাধ্যম ও গণ আকাঙক্ষা এ দুটি শব্দের এক করেছে। মানুষের ইচ্ছে খুঁড়ে বের করেছে। তারপর সেই ইচ্ছে পুরণ করেছে। চ্যানেল আইতে বহু মানুষ তার জীবনের ও পেশাজীবনের সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক শাহ আলমগীর, প্রণব সাহা ছিলেন এই পরিবারের। বরেণ্য নির্মাতা ও শিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠু ছিলেন এটি পরিবারের। এমন বহু মানুষ আছে। প্রখ্যাত শিল্পী সুবীর নন্দী, আইয়ুব বাচ্চু, এণ্ড্রু কিশোরের অগণিত দিনের স্মৃতি চ্যানেল আইতে। পাঠক তৈরির কারিগর কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদও ছিলেন এই পরিবারের। বাংলা সঙ্গীতের আরেক দিকপাল আজাদ রহমান এই কিছুদিন আগেও ছিলেন চ্যানেল আই একান্তজন হয়ে। তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। বাংলার আকাশের বড় তারকা যারা আছেন যারা নেই, বাঙালির সবচেয়ে গর্বের মানুষগুলো যারা আছেন যারা গত হয়েছেন তারা সবাই চ্যানেল আই এর প্রবাহিত নদীর সঙ্গে চলছেন। এই স্রোত পারস্পারিক। এই স্রোত সমন্বিত। এই স্রোত সামষ্টিক।
ছাতিম তলায় গান শোনা যায় কান ফাটানো। ছাদ বারান্দায় রোদের ভেতর চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন ছেলে বুড়ো দামাল সবাই। দুপুর ক্ষুধায় অন্য স্বাদের খাদ্য খানা, কোনোবারে কাচ্চি হলে আরেকবারে খিচুড়ি ভুনা। এসব কথা সুতোর মতো। একটা স্মৃতি ধরিয়ে দিলে প্রায় সাতশো কর্মী সবাই টান ধরবেন ভুরভুরিয়ে।
ছাতিম তলায় মেলা। মধ্যখানে রাজ লেবাসে পান সুপারির পান। দুইপাশে বহুপণ্যের পসরা। চ্যানেল আইয়ের বন্ধুরা সব। আরেক পাশে দেশবরেণ্য আঁকিয়েরা মাথছে ধুলো ছাতিম তলার। আঁকছে ছবি লাল সবুজের চেতনমাখা মূর্ত কিছু।
সন্ধ্যা নাগাদ দেশ এসে যায় চ্যানেল আইতে। প্রভাবশালী, শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী, দেশবরেণ্য, দুরস্ত সব মানুষগুলো এককাতারে। যারা কখনো একে অন্যের ছায়া মাড়াবে না তারাও দাঁড়ান পাশাপাশি কেক কাটবার নরম নরম ছুরি হাতে। যাদুর মতো ধারাভাষ্যে তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর ভাই অতিথিদের নাম পরিচয় বিস্তারিত বলে গেলেন এক নিঃশ্বাসে। দর্শকরা টাসকি খেতে খেতে চললো ছুরি শত পাউন্ডের কেকের ওপর। আতশবাজি, গানের আওয়াজ, কনফিটিসব ঝলমলে এক অন্যরকম সময় হয়ে অবাক রকম ঢুকে গেল সবার মনে।
এই হলো চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনের এক পশলা। আজ পয়লা অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের বাইশ বছরে পদার্পনে এসব আয়োজনের কিছুই হয়নি। শুধু করোনার জন্য। দেশ বিদেশের মানুষ শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। চ্যানেল আইয়ের পর্দার সঙ্গে থেকেছেন। নিউ নর্মাল সময়ে যা হয়।