চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

একজন স্বর্ণজয়ী মাবিয়া সীমান্তের কান্নার রঙ

প্রবাসী জীবন বেছে নিতে হয়েছে আজ থেকে অর্ধযুগ আগে। তার আগে আমার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাকরী জীবন অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি ‘বাংলাদেশের মেয়ে জীবন’ ঠিক কতোটা বর্ণময়(!)। অনেক বছর বাংলাদেশ যাওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের ‘মেয়ে জীবন’ নিয়ে এখন আছে একটা মিশ্র এবং অজানা অনুভূতি!

বিশেষ করে বাংলাদেশের ফেসবুক ইউজারদের মাধ্যমে প্রতিদিন এমন অভিনব সব অভিজ্ঞতা হয় যে আমি ভেঙ্গে পড়ি, মুষড়ে পড়ি, আহত হই, ব্যথিত হই, কান্না করি, কৌতুক বোধ করি। আবার দিনশেষে আশায় ‘বান্ধি’ বুক, আমার ‘বন্ধুদের দেখে’!!! নিজেকে বুঝাই এই তো আমার কাংখিত বাংলাদেশ। কিন্তু এর বাইরে হয়তো একটা মেয়ে টিভিতে কোনো একটা অনুষ্ঠান সঞ্চালন করছে সেটার একটা ছবি আর তার নিচে এক হাজার কমেন্টের মাঝে হয়তো ৬৯৯ টাই থাকবে মেয়েটার রূপ, দেহ এবং পোশাক আশাক নিয়ে এবং অবশ্যই তা ইতিবাচক কিছু না।

একজন ক্রিকেটার তার বোনের ছবি দিয়ে আবেগ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে, সেটিও কলঙ্কিত হয় অন্ধ এবং নোংরা মানসিকতার কাছে। এমন না যে এই ‘জনগোষ্ঠী’ আগে ছিলো না। ছিলো নানারূপে, নানাভাবে বাংলাদেশেই বসবাস, কিন্তু ফেসবুকের মত একটা বিশাল আকাশ পেয়ে ডানা ছাড়া পাখিরও আজ উড়বার প্রয়াস, এটাই দুঃখ!!!

দেশ ছেড়ে থাকার কারণেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক মন অতীব দুর্বল থাকে সব সময়। ‘দেশ’কে ঘিরে গলায় একটা দলা পাকানো কান্না এমনিতেই থাকে যখন তখন। দেশের আনাচে কানাচে থেকেও কোনো না কোনো একটা ভালো খবর মানেই ধরে নেই ‘এটাই বাংলাদেশ’।

অন্য মন খারাপ করা বিষয়াদি হয়তোবা বিচ্ছিন্ন! ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের মেয়েদের নিয়ে একটু ভালো খবর পেলেই শেয়ার করি কারণ আমি মেয়েবাদী এমন না বিষয়টা। আমি চাই ‘বাংলাদেশের প্রতিটা মেয়ে’ শুধুমাত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে আর যাই হোক প্রতিদিন মানসিকভাবে মরার আগেই মরে বেঁচে থাকবে না। বাংলাদেশেও প্রতিটা মেয়ে অন্য দশজন মানুষের মত তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা নিয়ে সৌন্দর্যবোধ নিয়ে একটা জীবন উপভোগ করে যেতে পারবে এই বাস্তবতায় থাকবে বাংলাদেশের প্রতিটা ছেলে মানুষের ইতিবাচক ভূমিকা।

একজন মাবিয়া সীমান্ত একটা সোনার মেডেল জয় করেছে, এটা শুধু আমাদের জন্যে একটা দুর্দান্ত সুখবরই হতে পারতো যেভাবে বিশ্বে খেলাধুলার জগতে বাংলাদেশ নামটি নতুন করে নানাভাবে প্রায়ই আমাদের সামনে উঠে আসছে। বিশেষ করে ক্রিকেট তো আমাদের লাল সবুজ পতাকাকে ভীষণ আনন্দ নিয়ে উড়াতে উপলক্ষ করে দিচ্ছে অবিরাম! মাবিয়া সীমান্ত, মাহফুজা শিলা আমাদের সোনা জয়ী কন্যা এবং আমাদের বুকের নিংড়ানো শুভেচ্ছা বাণী নিয়েই শেষ করে দিতে পারতো আমাদের আবেগ এই যাত্রা।

কিন্তু সেটা হয়নি, জাতীয় সঙ্গীতের সাথে মাথা উঁচু করে সীমান্তের চোখের জল আজ আমাদের কোটি বাংলাদেশিকে দাড় করিয়ে দিয়েছে যেন অন্য এক ‘আবেগি বাংলাদেশি’ হিসেবে। মাবিয়ার কান্না দেখে  চোখ এবং মন এক সাথে ভিজে একাকার হয়েছে লাখো বাংলাদেশির।

মাবিয়ার কান্না বাংলাদেশের রাজনীতির নোংরা জালে জড়িয়ে আছেন এমন অনেক মানুষকেও কেমন যেনো ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য একটা মানুষ রূপে নিয়ে আসে একটু সময়ের জন্যে,আমি দেখি, মুগ্ধ হই, অবাক হই!!!

আমি মেয়েটির কান্না দেখে একদম শুরুতেই একদফা কেঁদেছি অন্য আরো অনেকের মত। কিন্তু গত দু’দিন ধরে যা করছি তা হচ্ছে যখনই ফেসবুক খুলছি ট্রেনে বাসে বাসায় বা ঘুমানোর আগে সুযোগ পেলেই আরো একবার দেখে নিচ্ছি মন ভরে, চোখ বারবারই ভিজে যাচ্ছে গলায় আটকে থাকছে কি একটা যেন অনেকক্ষণ। ‘ভালোবাসা তোমার জন্যে কাঁদছি’ দেশের জন্যে ভালোবাসা, কি ভীষণ সুখের এই কান্না! সুখের কান্না বলছি কারণ এই প্রথম শুধু নিজেই ভাঙছি-চুরছি তা না, চারদিকে থাকা অসংখ্য মানুষকে দেখছি ‘বিশুদ্ধ সরল এক বাংলাদেশি’ হিসেবে নতুন করে।

মাবিয়া যখন কান্না করছিল কি হচ্ছিল ওর বুকের ভিতর, বুঝা না বুঝা সেই আবেগকে আসলে সঠিক শব্দ চয়নে বাধা সাধ্যের অতীত। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল ‘ওর এই সাধনাকে ঘিরে ওর চলার পথে যারা নানান সময় মন খারাপ করা বাক্যবাণে জর্জরিত করেছিল ওর কি মনে হয়েছিল ‘তোমরা দেখ আমি পেরেছি’। ওর কি মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল? ওর কি মনে হয়েছিল ‘বাংলাদেশের মানুষেরা যদি জানতো দেশের হয়ে এভাবে লাল সবুজের পতাকা’টা উড়তে দেখার উপলক্ষ করতে পারাটা কী পাগল করা সুখ!!! সোনার কন্যা মাবিয়া, মাহফুজা আমিও বলতে চাই আনন্দ অশ্রু নিয়ে ‘তোমাদের চোখেই বিশ্ব দেখুক আজকের বাংলাদেশ’।

মাবিয়ার কান্নার রঙ আসলে ‘এক টুকরো লাল সবুজের ক্যানভাসে আঁকা একটা প্রিয় প্রিয় পোট্রেট’ হয়ে থাকবে বুকের মাঝে বাংলাদেশ নামের ছোট এই মানচিত্র থাকা প্রতিটা মানুষের মন ও মননে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)