চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

একজন ভালো পুলিশের আত্মজীবনী

প্রতিদিনই খবরের কাগজ ও টিভির চ্যানেলে যত খবর থাকে, গুনে দেখলে দেখা যাবে, তার প্রায় অর্ধেকই পুলিশ সংক্রান্ত। এর নব্বই শতাংশ আবার পুলিশের ব্যাপারে নেগেটিভ। বড় জোর দশ ভাগ কোনও শিশু শিক্ষার্থী, কিংবা বয়সী নারী কিংবা অন্ধকে পুলিশ হাত ধরে রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে, কোন জঙ্গি দলের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে, বা বহু পুরনো কোন সেনসেশনাল মামলার আসামীকে পুলিশ বহু চেষ্টার পর ধরে এনেছে — এ সব পজিটিভ খবর। তবে রেয়ার আর্থের মতোই রেয়ার। এক একটা শাসনকাল সাধারণ মানুষের চোখে ভাল কি মন্দ, তার বিচারের অন্তত সিকিভাগ জুড়ে থাকে সেই শাসনকালে পুলিশের ভূমিকা।

কি এরশাদের আমল, বেগম খালেদা জিয়ার আমল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিংবা শেখ হাসিনার আমলে-পুলিশের ভূমিকার খুব একটা হেরফের নেই। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে কিংবা ব্রিটিশ আমলে পুলিশ কেমন ছিলো, তার হদিশ পেতে হলে পুরনো খবরের কাগজ ঘাঁটা ছাড়া গতি নেই।

তা–ও খবরের সব খবর যে ধ্রুব সত্য নয়, খাঁটি দুধেও যে অনেক সময় তিন ভাগ জল মেশানো থাকে, এ সত্য সবাই জানেন। সম্প্রতি একটি চটি বইয়ের মাধ্যমে পুরনো দিনের পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে জানা গেলো। ভদ্রলোক বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন। এক সময় তিনি এপার বাংলায় পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের অত্যন্ত উঁচু পদের অফিসার হন। পুলিশরা কীভাবে কাজ করেন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে – এসব বিষয়ে বেশ কিছু কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য আছে বইটিতে। পাঠকদের জন্য তা নিবেদন করছি।

ওই মানুষটি তার আত্মজীবনীর প্রায় শুরুতেই লিখেছেন: ‘সে সময়ও জনসাধারণের কিন্তু পুলিশের ওপর বিশ্বাস ছিলো না। সব সময়ই জনগণ পুলিসকে অবিশ্বাস করত, এখনও করে। এই অবিশ্বাসটাকে যে অবশ্যই দূর করা দরকার এটা চাকরির আগে থেকেই বুঝতাম। চাকরি পাবার পরও জনসাধারণের কাছ থেকে এরকম মন্তব্য শুনেছি যে, পুলিশকে বিশ্বাস করা চলে না।’

পুলিশের চাকরিতে ঢোকার পর প্রথম পোস্টিং হলো পূর্ববঙ্গে। নিজে লিখছেন, ‘তখন পূর্ববঙ্গের অবস্থা খুব ভাল ছিলো। পদ্মা নদী ছিলো ভীষণ চওড়া। মাছ, দুধ ছিলো অকল্পনীয় সস্তা। আমার মনে আছে তিন পয়সা সের নির্ভেজাল দুধ খেয়েছি। ৬ আনা সের মাছ খেয়েছি। শুধু এখানে (পূর্ববঙ্গে) কেনো, ১৯৩০ সালে যখন কলকাতায় আসি তখনও তো মনে আছে ১২ আনা সের ভাল পোনা মাছ প্রায়ই খেতাম।’

মানুষটির জন্ম রাজশাহী শহরে। বাবা ছিলেন রাজশাহীর সিভিল কোর্টের কেরানি। ছয় ভাই, পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে সেজো। স্কুলে পড়ার সময় ‘দু’মাইলের পথ দু’পয়সা ভাড়া দিয়ে এক্কা গাড়ির মত টমটম গাড়িতে যেতাম।’ ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রাজশাহী ডিভিশনে প্রথম তিনি। আইএসসি ও বিএ পড়েন রাজশাহী কলেজে। এমএ কলকাতায়।

এই ভদ্রলোক ১৯৩৬ সালে বরিশাল থেকে বদলি হয়ে যোগ দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এসডিপিও হিসেবে। লিখছেন, ‘গিয়েই দেখলাম ওখানকার লোকেরা পুলিশকে একদমই মানতে চায় না। এছাড়া বিশ্বাসের ব্যাপারটাও একদম নেই।’ ১৯৩৮। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের ঝগড়া চলছে। এর ভেতরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষচন্দ্র বোস ও সেক্রেটারি আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, খবর এলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছেন। এসডিপিও ছুটে গেলেন এসপি’র কাছে। বললেন কংগ্রেস-লীগ কাজিয়া হতে পারে, কিছু একটা করা দরকার। তখন এসপি ছিলেন মুসলিম। বললেন, ‘দরকার নেই, কিছু কোরো না।’

সব শুনে ডিএম বললেন, ‘এসপি যা বলেছেন তাই শোনো।’ কিন্তু তরুণ এসডিপিও সেদিন ব্যবস্থা না নিলে সুভাষচন্দ্র গুরুতর আহত হতেন। লীগপন্থিদের ছোঁড়া রেল লাইনের পাথরে সুভাষচন্দ্র আঘাত পান। এসডিপিও তাকে এসকর্ট করে শহরের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। একটি রায়ট বন্ধ করেন।

এর পরের কাহিনী কলকাতার। ১৯৪৬–এ পরাধীন দেশে বাংলার প্রধানমন্ত্রী তখন সোহরাওয়ার্দী। লিখছেন, ‘হ্যাঁ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো। ১৯৪৬–এ রাইর্টাসে যখন উনি এলেন, দেখলাম পুলিশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াচ্ছেন!’

ভারত দেশ বিভাগের পর আরও ২২ বছর ভদ্রলোক চাকরি করেছেন। তিনি কলকাতা পুলিশের কমিশনার, পরে রাজ্য পুলিশের আইজি হন। তখন রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ পদ ছিলো আইজি।

পুলিশের ওপর রাজনৈতিক চাপ যে থাকে এ কথা সবাই বিশ্বাস করে। উনি লিখছেন, ‘পুলিশের ওপর বিধানবাবু মারফত কখনও কোনও রাজনৈতিক চাপ এসেছে বলে আমার তো মনে পড়ে না।’ ১৯৬২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একটি আসনে হারার মুখে – খবর পেয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক ত্যাগী নেপাল রায় কংগ্রেসিদের নিয়ে গন্ডগোল করছিলেন। উনি ডা. রায়কে ব্যাপারটা বলতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তুমি যা ভাল বুঝবে তাই করবে।’ আমি নেপাল রায়কে রাস্তা থেকে হটিয়ে দিয়েছিলাম।

১৯৬৬। বামেদের খাদ্য আন্দোলন তুঙ্গে। ভদ্রলোক আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সে সময় কিছু আইএএস অফিসার প্রফুল্লবাবুকে বাজে উপদেশ দিয়ে মিসগাইড করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী (প্রফুল্লচন্দ্র সেন) চিন্তিত হলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘পুলিশ গুলি করুক, পুলিশ গুলি করছে না কেনো?’ আমি বলতাম, ‘স্যার গুলি করাটা ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়। ওরা না খেতে পাওয়া মানু্ষ।’ এই ঘটনায় প্রফুল্লবাবু কিন্তু বার বার আমাকে চাপ দিয়েছিলেন গুলি করার জন্য। এই ঘটনার পর কংগ্রেস সরকার তার সব রকম জনপ্রিয়তা হারায়। সে জন্য ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস তো হারলোই, এমনকী আরামবাগে প্রফুল্লচন্দ্র সেন নিজেও হারলেন।’

১৯৬৯ রাজ্যপাল ধর্মবীর ভদ্রলোককে ১ বছর এক্সটেনশন দিতে চাইলেন। উনি কিন্তু রাজি হলেন না। শেষে ঠিক হলো, সামনে বিধানসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচন, তাই তিন মাস তিনি আরও আইজি পদে থাকবেন। ফেব্রুয়ারিতে ভোট হলো। যুক্তফ্রন্ট প্রচণ্ড সংখ্যাধিক্য নিয়ে আবার ক্ষমতায় এলো। অজয় মুখার্জি আবার মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসু ১৯৬৭’র মতো এবারও উপমুখ্যমন্ত্রী, তবে স্বরাষ্ট্র দপ্তর তার হাতে।

ভদ্রলোকের অবসর নেয়ার কথা ৩১ মার্চ। এদিকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কাগজে বেরিয়ে গেলো, যুক্তফ্রন্টের প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ঠিক হয়েছে, এবার ভদ্রলোককে আর একদিনও আইজি পদে রাখা হবে না। ওর পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে বিদায় দেয়া হবে। তখনও বাকি ১৩/১৪ দিন। দুপুরে অজয়বাবুর সচিব ডেকে পাঠালেন। গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এলেন জ্যোতি বসু, যতীন চক্রবর্তীরাও। লিখছেন, ‘জ্যোতিবাবুই আমায় প্রথম বললেন, আমরা ঠিক করেছি যে আপনার সঙ্গে মানিয়ে কাজ করতে পারব না।’

ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘খবরের কাগজকে বলার কী দরকার ছিলো?’ জ্যোতিবাবু বললেন, ‘১২ পার্টির ক্যাবিনেট, কাগজে কে দিয়েছে তা বলতে পারছি না।’ ভদ্রলোক তখন এক মন্ত্রীর নাম করে বললেন, উনি দিয়েছেন। ‘আমাকে বললেই চলে যেতাম। জোর করলে মামলা করে বাকি কটা দিন থাকতে পারি। কিন্তু থাকবো না।’ শেষে লিখছেন, ‘খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম জ্যোতি বসু ওয়াজ ভেরি অ্যাপলোজেটিক।’

১০ মার্চ রিটায়ার করলেন, মেয়াদ ফুরনোর ২১ দিন আগে। আর কোনোদিন রাইটার্সে যাননি। বাইরে অনেক বড় ভাল কাজ ও মোটা মাইনের অফার পেয়েও নেননি। থাকতেন বালিগঞ্জে নিজের বাড়ি ‘দুরাশা’য়। আমৃত্যু। রাইটার্স থেকে চলে যাওয়ার দিন জ্যোতি বসুর সঙ্গে তার শেষ কথোপকথন:

‘জ্যোতি বসু: একবার আপনার পাশের বাড়ির ছাদ থেকে আপনার ছাদের বাগান দেখেছি। আমি তখন ধরা গলায় বললাম, হ্যাঁ স্যার আমি ফুল ভীষণ ভালবাসি। উনি বললেন, ফুল আমিও ভালবাসি।’

ভদ্রলোকের নাম উপানন্দ মুখার্জি। আর তার আত্মজীবনী: ‘এই পুলিশ জীবন।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)