মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সাংবাদিক অজয় বড়ুয়া মারা গেছেন শুক্রবার সকালে। তিনি দৈনিক সংবাদে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট কাভার করতে গিয়ে কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। লন্ডনের সেন্ট বার্টস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন দুই সপ্তাহ।
অজয় বড়ুয়ার নিকটজন ও দৈনিক সংবাদে তার সহকর্মীরা জানান, গত দুদিনে তার শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। শঙ্কার সেই দোলাচল থেকে আর ফিরলেন না। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোর ৭.২০ মিনিটে ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ গুণীজন। তার মরদেহ যতদ্রুত সম্ভব ঢাকায় আনার কথা বলেছেন স্বজনরা।
আগাগোড়া একজন সজ্জন মানুষ অজয় বড়ুয়া স্ত্রী, এক পুত্র, দুই কন্যা রেখে গেলেন পরিবারে। আর রেখে গেলেন বহুমাত্রিক এক কর্মময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প। কৃতি ক্রীড়াবিদ ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করেছেন, বাম রাজনীতির (ছাত্র ইউনিয়ন) সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ছিলেন জগন্নাথ হলের ক্রীড়া সম্পাদক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরে সাড়ে চার দশক ধরে নিরলসভাবে করে গেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতা। তার চলে যাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মকথার গল্প, ক্রীড়াক্ষেত্রের নানা চড়াই-উতরাই আর সাফল্য-ব্যর্থতার এক এনসাইক্লোপিডিয়া হারিয়ে গেল!
বিশ্বকাপ কাভার করতে গত ৩১মে সস্ত্রীক লন্ডন যান অজয় বড়ুয়া। বাংলাদেশের প্রথম তিনটি ম্যাচ কাভার করেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে কয়েকদিন জ্বরে ভুগেছেন। জুনের শেষ সপ্তাহে প্রথমে তাকে লন্ডনের কিং জর্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নিউমোনিয়া, হৃদরোগ ও অন্যান্য জটিলতা সামনে আসে। পরে সেন্ট বার্টস হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার হৃদপিণ্ডে সফল একটি অস্ত্রোপচারও হয়। সবশেষে কেবল বাড়ি ফেরা হল না সকলের প্রিয় অজয় দা-র।
দীর্ঘ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার আর বহুমাত্রিকতার জন্য কয়েক প্রজন্মের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল অজয় বড়ুয়ার সখ্যতা। জন্ম চট্টগ্রামে, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সাল। বন্দরনগরীর কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজে এসএসসি-এইচএসসির পাট চুকিয়ে পাড়ি জমান রাজধানীতে। স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
শৈশব থেকেই খেলাধুলার প্রতি যে ঝোঁক, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও ছাড়তে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। অল ইউনিভার্সিটি টিমের হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেছেন। ছিলেন জগন্নাথ হলের ক্রীড়া সম্পাদক। ঢাবিতে ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য সম্মাননা সূচক ব্লু পেয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী আবাহনী ক্লাবের (গঠন পর্যায়ে) শুরুর দিকের ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অজয় বড়ুয়া। স্বাধীনতার পর ক্যারিয়ার গড়তে বেছে নেন সাংবাদিকতা। ক্রীড়া ও বিভিন্ন বিষয়ের গভীরে আলো ফেলার স্পৃহাটা তো আগে থেকেই ছিল। ১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেন ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবে। সাড়ে চার দশক ধরে সেখানেই কাজ করে গেছেন। মৃত্যু অবধি সংবাদের ক্রীড়া সম্পাদক ও ইউনিট চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার হাতে ক্রীড়ালেখার পাঠ পেয়েছে অনেক তরুণ সাংবাদিক।
পেশাজীবনে অনেকবার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট কাভার করেছেন। ১৯৮০ সালে ব্যাংককে যুব এশিয়ান ফুটবল কাভারের মধ্য দিয়ে যে যাত্রার শুরু। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ প্রথম যেবার বিশ্বকাপ খেলতে গেল, সংবাদের হয়েই সেই আসর কাভার করেছেন অজয় বড়ুয়া। ইংল্যান্ডেই আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপের মাঝপথে চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে।
ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি, সাংবাদিকতা জীবনে আবার বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সদস্য ছিলেন। পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। পেশাদার রিপোর্টারদের অন্যতম সংগঠন ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যও। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সিনিয়র সদস্য ছিলেন। ছিলেন ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যও।
অজয় বড়ুয়া সেই ১৯৭৪ সালে শুরু করেছিলেন পেশাদার ক্রীড়ালেখা। আমৃত্যু সেটাকেই ভালোবেসে গেছেন। ভালোবেসে ছায়া দিয়ে গেছেন চারপাশের মানুষকে। তার প্রস্থানে সাংবাদিকতা হারাল একজন নিবেদিতপ্রাণ দিকপালকে। আর বাংলাদেশ হারাল গঠনকালের এক চাক্ষুষপট সাক্ষীকে।