মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি এবার একটা অনুরোধ করতে চাই দয়া করে মানা করবেন না। অনুগ্রহপূর্বক দেশে একজন দুর্ঘটনা মন্ত্রী নিয়োগ দিন। একজন দুর্ঘটনা মন্ত্রীর বড় প্রয়োজন আজ এই দেশে।
দুর্যোগ মন্ত্রী না, তিনি তো আছেনই। দেশে এখন দুর্যোগের চেয়ে দুর্ঘটনা বড়। আমাদের দেশে অনেক কৃষক আছে তাই আছেন কৃষিমন্ত্রী। দেশে অনেক অর্থ আছে তাই আছেন অর্থ মন্ত্রী। দেশে অনেক পরিকল্পনা আছে তাই আছেন একজন পরিকল্পনা মন্ত্রী। বিশ্বাস করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশে এখন সবচাইতে বেশি আছে দুর্ঘটনা। তাই একজন দুর্ঘটনা মন্ত্রী একান্ত প্রয়োজন। এ কথা সবাই জানে যে একজন মন্ত্রী তো আর বসে বসে খাবে না। কিছু কাজ হলেও তাকে করতে হবে। আর তাতেই দেশের মানুষ কিছু উপকার পাবে। দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাবে।
মানুষ প্রতিদিন পথে নামে বাজার সদাই করে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। ঘরের মানুষগুলো চুলার পাশে বসে থাকে আপনজনের অপেক্ষায়। অথচ তাদের ঘরে বাজার সদাই নিয়ে আর কেউ ফিরে আসে না। আসে না এইজন্য যে দেশে সড়ক রেলপথ নৌপথে চোরাবালির মত বসে থাকে দুর্ঘটনা। ওরা আসেনা তো আসেই না। তাই চুলার পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর পেটেও কিছু জুটে না। জুটে না তো জুটেই না বছরের পর বছর।
স্কুল কলেজে যাবার জন্য মানুষ ঘর থেকে বের হয়। তাদেরও কেউ কেউ ফিরে না ঘরে। ঘর মানে তো মা বাবা ভাই বোন সন্তান। ওদেরও অপেক্ষার পালা কোনদিন শেষ হয় না। কাজেই পড়ার টেবিলের বইগুলো এলোমেলো পড়ে থাকে। বই পড়ার কেউ থাকে না সেখানে। এভাবেই দেশ থেকে একটু একটু করে অনেক পড়ুয়ারা হারিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আমাদের দেশের মন্ত্রী এমপিদের পুত্র-কন্যারা এখন মোটামুটিভাবে সবাই বিদেশে থাকে। সামান্য একটু পয়সা থাকার কথা যার তারও অঢেল পয়সা হয়ে গেছে বলে ঐ সমস্ত পরিবারেরে সন্তানেরাও বিদেশে পড়ালেখা করছে। ছোট বড় মাঝারি সাইজের সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানেরাও অনেকে বিদেশে থাকে। মাত্র চল্লিশ পাঁচ চল্লিশ বছর আগে যে ধরনের অফিসারদের মাথার ওপর পাখা ঘুরত এখন তাদের প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি গাড়িতে এসি চলে। এই মাঝারি ছোট বড় অফিসারদের আয় রোজগার যে একটা গরিব দেশে কোথা থেকে আসে কে জানে? এই সমস্ত সরকারি স্বায়ত্তশাসিত বেসরকারি অফিসারদের পরিবারের সন্তানেরাও বিভিন্ন দেশে পড়ালেখা করতে চলে যায়। যায় মানে সব কিছু শেষ করেই চলে যায়। কাজেই এরা দুর্ঘটনার হাত থেকে বহু দূরে।
কিছু কিছু পরিবারের যে অভিভাবক ব্যক্তিটি আয় রোজগার করেন না তিনিও থাকেন বিদেশে। অর্থাৎ হয় স্বামী না হয় স্ত্রী। আয়ের উৎস দেশের মাটিতে থাকায় যিনি আয় রোজগারের কর্তা ব্যক্তি তাকে থাকতেই হয়। স্বর্ণের খনি তো হাত ছাড়া করা যায় না তাই তিনি স্বশরীরে দেশে থাকেন তিনি। রুজিরোজগারের জন্য এবং বস্তায় বস্তায় টাকা ভরার জন্য পড়ে থাকেন অনিচ্ছায়। কিন্তু তার মন প্রাণ হৃদপিণ্ড কিডনি চোখ নাক কান গলা সব পড়ে থাকে বিদেশে। এরা ট্রেন বাস ট্রাকের নিচে কোনদিন দুর্ঘটনার কবলে পড়বে না।
কিছু কিছু রাজপুত্রদের নিয়ে অনেক গল্প ও খবর শোনা যায়। রাজপুত্র রাজকন্যারা ফুর্তি করবে না তাতো হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো সামান্য ফুটো দিয়ে যখন ওদের সামান্য একটু ফুর্তি বেড়িয়ে পরে তখন দোষ হয় আপনার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বাস করুন তখন সামান্যতম বিবেক না খাটিয়ে, সামান্য চিন্তা ভাবনা না করে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিংবা কাগজে কলমে কিছু মানুষ আপনারই দিকে আঙ্গুল তোলে। তোলে মানে একবার তুললে আর নামাতে চায় না। আপনার যোগ্যতার কথা, সাহিত্য অনুরাগী হবার কথা, শিশুসুলভ একটা মনের কথা, আপনার স্বপ্নের কথা ওরা ভুলে যায়।
এমন কি আপনার বুক ভরা দেশ প্রেম তাও তারা মানতে চায় না। নিজেরা তো ভুলে যায়ই অন্যকেও প্রলুব্ধ করে আপনাকে যেন সবাই ভুলে যায়। এইভাবে একটা পরিসংখ্যান তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এইযে আমাদের বড় করে দেখতে শেখালেন। বিশ্বাস করালেন অসম্ভব বলে কিছু নেই। এইযে পরিবর্তনের যে জোয়ার এনে দিচ্ছেন। এইযে অনেক বিষয়ে আপনার জিরো টলারেন্স সেগুলো ওরা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যায়। কিন্তু ভুলে না আপনার অধীনস্থ অন্যের গাফলতির কথা। তখন আর বলে না অন্যের গাফিলতি। কোন বিভাজন না রাখে আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে ধরে ওরা।
আপনি প্রচুর দান করেন, মাঝে মধ্যে ক্ষমা করেন, আবার শাস্তিও দেন। তাতো আমরা দেখছি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এখনো এই বয়সে আঠারো উনিশ ঘণ্টা কাজ করেন। প্রতিটি ফাইল লাইন বাই লাইন পড়ে লাল কালো কালি দিয়ে দাগ দেন।
তারপরও দেশের জন্য, দলের জন্য সাধারণ মানুষগুলোর জন্য সব সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। তবু কোথায় কোন গাছ পড়ে গেলে আপনাকেই হুকুম দিতে হয়। কোথাও নদী থেমে গেলে আপনাকেই খোঁজখবর নিতে হয়। এই একটি মাত্র মাপকাঠি দিয়ে বোঝা যায় নিচের মানুষগুলোর অযোগ্যতার পরিমাপ এবং তাদের কর্ম দক্ষতার কত বেশি অভাব। কে পারবে এতসব কাজ এক হাতে করতে। অথচ আপনি তাই করছেন। ওরা আপনাকে দিয়ে তাই করিয়ে নিচ্ছে। আপনি না চাইলেও একজন ইউএনও, একজন জেলা প্রশাসক একজন বিভাগীয় প্রশাসক, সচিব এম পি, মন্ত্রী সবাইকে ডিঙ্গিয়ে দেশের মানুষ আপনার কাছে যেতে চায় ন্যায় বিচারের আশায়, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো ফিরে পাবার আশায়। যেন আপনি প্রধান না আপনি প্রথম মন্ত্রী।
তাই মনে হচ্ছে যদি প্রতি থানার জন্য একজন করে মন্ত্রী বানিয়ে দেন তবুও আপনাকে এভাবেই কাজ করতে হবে। কাজেই এখন সময় এসেছে এদেরও বিচার করার। অনেক বিচার সাফল্য রয়েছে আপনার ঝুলিতে। একবার হাত দিয়েই দেখেন সাফল্য আপনার নিশ্চিত। কেননা দেশের মানুষ আপনার পাশে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এরপর অসৎ অযোগ্যদের বিচার করলে ইতিহাস আপনাকে থ্রি স্ট্রাইক লেডি বলে জানবে।
বিচার করুন আপনার নৌকাকে খেয়া নৌকা বানিয়ে যে যার মত পার হয়ে যাচ্ছে, তাদের। বঙ্গবন্ধুর নৌকা ছিল টাবুরে নৌকা। লোকে সেটাকে যত্ন করে ঘাটে বেঁধে রাখতো। পানি খেঁচতো। ফুটো সারাত। আলকাতরা লাগাত। ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। আপনার নৌকাও তাই হবার কথা ছিল। আপনিও মনে প্রাণে তাই আশা করেছিলেন। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের বড় একটা গোষ্ঠী কিংবা আপনার দলের কিছু মানুষ আপনারই নৌকায় এক পা দিয়ে উঠে অন্য পা দিয়ে লাফিয়ে নেমে যাচ্ছে। মানে নৌকা হল শুধু এপার থেকে ওপারের যাবার জন্য। আপনি যাদের পার করে দিচ্ছেন যখন আপনি পার হতে চাইবেন সেদিন নৌকা নিয়ে কে কে বসে থাকে সেটা দেখার আগ্রহ অনেকের মত আমারও আছে।
পার হতে হতে অনেকেই ঘাট থেকে বহু দূরে চলে গেছে। সেই পার হল পরিবারকে বিদেশ পার করে দেওয়া। দশজনের হক একজন ভোগ করা, হাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ একজনের ঘরে তুলে আনা, লাখ মানুষের ভাগ্য মুছে দিয়ে এক কপালে তিলক লাগিয়ে ঘুরে ফেরা।
যারা ঘাট ছেড়ে বিমানবন্দরে গেছে, তারা আপনার জন্য একদিনও পথে নামবে না। এরা আপনার জন্য কোন মিটিং এ যায় না। যাবে যদি, টেলিভিশনে তার মুখ দেখা যায়, যাবে যদি জানতে পারে আপনি দূর থেকে হলেও দেখতে চান সে মিটিং এ উপস্থিত ছিল কি না। তা না হলে ঘরে ঘরে এসি আছে, ডিস আছে, বিদেশে ছেলে মেয়ে স্ত্রী আছে তাদের সাথে হোয়াটসএপ, স্কাইপ, ফেসবুক করবে। এদের সন্তানেরাও আপনার জন্য কোনদিন শ্লোগান দেয় না। আগে হয়ত দিত তখন এদেরও দুর্ঘটনার স্বীকার হবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু এখন এরা দুর্ঘটনার ঊর্ধ্বে। অথচ আপনার বর্তমান কর্মীরা যারা মিছিল মিটিং কিংবা এখনো পথে থাকে তারা দুর্ঘটনার চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিও জানেন প্রতিদিন কত লোক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিচ্ছে। প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হয় দুর্ঘটনার ছবি দিয়ে। সেই ছবিতে যাদের মুখ দেখা যায় ওরা আর কোনদিন যাবে না মিটিং মিছিলে খেলার মাঠে। ওদের পড়ার টেবিলে বইগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকবে। ওদের আপনজন বাজারের অপেক্ষায় চুলার পাশে বসে থাকবে অনন্ত কাল। যখন সাংবাদিক ভাইয়েরা ওদের ছবি তুলে লাশকাটা ঘরে, তখনও ওদের শরীরে অনেক উত্তাপ। কেননা সে ঐ উত্তাপ নিয়েই ওরা কিছুক্ষণ আগে পথে নেমে এসেছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)