নারী-পুরুষের সমান অধিকারই জেন্ডার সমতা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ জীবনের সব পর্যায়ে যখন নারীর সমান অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা হয়, তখনই সমাজ সমতার দিকে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে পড়া সমাজে নারীর উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমেই সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সমাজে দিন দিন জেন্ডার অসমতা বেড়েই চলেছে। অথচ শারীরিক পরিবর্তন ছাড়া মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু যৌন ও পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য আছে, বাকি সব অঙ্গ একই রকম।
জৈবিক বা শারীরিক এ গঠনের জন্যই ছেলেরা পুরুষ লিঙ্গে অবস্থান করে আর মেয়েরা অবস্থান করে নারী লিঙ্গে। আর নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি বা সংজ্ঞাকে বলে জেন্ডার, কেউ কেউ বাংলায় একে সামাজিক লিঙ্গ বলে থাকেন। এই জেন্ডার বৈষম্য প্রকৃতির তৈরি নয়। সমাজ তাকে বৈষম্যের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষে পরিণত করে। সমাজই বেঁধে দেয় মেয়েলি ও পুরুষালি বৈশিষ্ট্য।
বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি বৈষম্য দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত প্রসারিত। খাদ্য, পু্ষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিনোদন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে পুরুষরা ভোগ করে প্রচলিত অগ্রাধিকার। আর অন্যদিকে মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে যৌতুকের জন্য গলায় দড়ি। উন্নয়নশীল দেশ ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অসমতার চর্চা বেশি হয়। পিতৃতন্ত্র কেবল নারীকে অবদমন করে না বরং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি।
জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রীয় নীতি ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন জরুরি। প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে পিতা-মাতা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা কন্যাশিশু অপেক্ষা ছেলেশিশুর প্রতি অধিক যত্নবান হয়। খাবার, শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ- সব ক্ষেত্রেই ছেলে শিশুর চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিহার করে সমতার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
উল্লিখিত কথাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমলা ভাসিনের। এই কথাগুলোকেই জনপ্রিয় করার জন্য তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য জেন্ডার সচেতনতা বাড়ানো। নারী অধিকারের পক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। সামাজিক জাগরণ ঘটানো। ভারত-নেপাল-শ্রীলংকা-পাকিস্তান-বাংলাদেশে নারীবাদী চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন।
পশ্চিমা নারীবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে স্থানীয় প্রেক্ষিত যুক্ত করে সহজ ভাষায় তিনি এ উপমহাদেশে নারীবাদ প্রচার করেছেন, নারীপুরুষ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের মৌলিক ভাবনাগুলো সঞ্চালিত করেছেন। তিনি একজন খ্যাতিমান জেন্ডার প্রশিক্ষক। আজ যারা উপমহাদেশে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন, তাদের প্রায় সবারই ‘মেন্টর’ হলেন কমলাজি। ৭০ বছর বয়সী কমলা জীবনভর একই আদর্শে স্থিত থেকেছেন, একই ভাবে লড়াইয়ের মাঠে আছেন। বিশ্বাস, আদর্শ, উদ্যম, ত্যাগ কোনোটিই তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এতটুকু গড়বড় হয়নি।
১৯৪৬ সালে জন্ম নেওয়া কমলা বড় হয়েছেন ভারতের রাজস্থানে। রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জেন্ডার সমতা, মানবাধিকার, শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ বেশিকিছু বিষয় নিয়ে তার শক্তিশালী লেখালেখি আছে। তিনি নিজেকে একজন গীতিকার হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন গণআন্দোলনের সময় তিনি গান লিখেছেন। শিশুদের জন্য, নারীদের হয়ে নানা সময় তিনি কবিতা লিখেছেন। নিজের সম্পর্কে যার মূল্যায়ন: আমি একজন নারীবাদী, আমি একজন মানবাধিকার কর্মী, আমি একজন কবি, সমাজসচেতন মানুষ, আমি কমলা।
তিনি আন্দোলনের প্রথাগত রূপ ভেঙ্গে দিয়েছেন। নাচ-গান-আমোদ-আহলাদের সঙ্গে নারীর এক্টিভিজমকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি নারীকে, প্রতিবাদকারীকে দেখেন একজন সারভাইবারস হিসেবে, ভিকটিম হিসেবে নয়। যারা হাসবে, নাচবে, গাইবে। এ ক্ষেত্রে নাচ গুরুত্বপূর্ণ কারণ, পুরুষতন্ত্র নারীর শরীর নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো, এভাবে ঢেকে রাখো, শরীরের কোনো অংশ দেখিও না। সেদিক বিবেচনায় নারীর শরীরের ওপর পুরুষতান্ত্রিক যে নিয়ন্ত্রণ-তার বিরুদ্ধে নাচ খুব শক্তিশালী অস্ত্র।
এ ছাড়া নাচ-গান তিনটি বিষয়কে সম্পৃক্ত করে-শরীর, হৃদয়, মন। নাচ ও গান ইমোশনকে ছুঁতে পারে। তাই প্রতিবাদ-আন্দোলন বা ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে শুধু বিরক্তিকর বক্তৃতা নয়, নাচ-গানকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। এর মাধ্যমে একটা শক্তি, আগ্রহ ও উদ্যমের সৃষ্টি হয়। তিনি পুরুষতান্ত্রিক ভাষা ও মূল্যবোধ পরিবর্তনের উপরও গুরুত্বারোপ করেন। যার সঙ্গে থাকবেন সেই পুরুষকে স্বামী, পতি হিসেবে সম্বোধন করা না। কেন যাবে না? কারণ পুরুষরা নারীর ‘ঈশ্বর’ নয়, সঙ্গী, সহযাত্রী।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াইয়ে কমলার অবদান অপরিমেয়। তিনি এ অঞ্চলের অনেক সংগঠন ও নেটওয়ার্কের নেপথ্য কারিগরের ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অফ জেন্ডার একটিভিস্ট অ্যান্ড ট্রেইনার্স (South Asian Network of Gender Activists and Trainers) বা সংক্ষেপে সাংগাত। এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কমলা ভাসিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সামনে এগিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সয়েছেন চরম দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা। কৈশোর থেকেই বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের বহু আন্দোলন তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। মৃত্যু, জুলুম-অত্যাচার-শোষণ-উৎপীড়িতের কান্না তাকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রতিনিয়ত নানা বাধা-বিঘ্ন-বৈরীতা মোকাবিলা করে তিনি জীবনের পথে এগিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনেও এসেছে নানা আঘাত ও বিপর্যয়। বছর কয়েক আগে আত্মঘাতী হন তার এক কন্যা।
মায়ের মতোই উজ্জ্বল, মেধাবী ও মানবিকগুণসম্পন্ন এই মেয়েটি মৃত্যুর সময় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ওপর অন্যান্য মুসলমান সম্প্রদায় ও বিভিন্ন রাষ্ট্র যে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে তার ওপর গবেষণা করেছিলেন। কর্মক্ষেত্রে পাহাড় সমান বাধা, কন্যা হারানোর হাহাকার আর জীবনের যাবতীয় বিপর্যয়ের পরও কমলা ভাসিনের প্রাণশক্তির ভান্ডার যেন অফুরন্ত। তার উপস্থিতি বিপন্নতম মানুষটির মুখেও হাসি ফোটায়, নিজের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনে। তীক্ষ্ণধী, অসম্ভব রসবোধ সম্পন্ন প্রাণশক্তিতে ভরপুর এবং সদা কর্ম-চঞ্চল এই মানুষটি আন্দোলন পরিচালনার পাশাপাশি লিখেছেন বহু বই। নারী অধিকার বিষয়ে তার তাত্ত্বিক চিন্তা নারী আন্দোলনকারীদের দিচ্ছে দিক নির্দেশনা, যোগাচ্ছে অনুপ্রেরণা।
কমলার মতে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব থেকে সৃষ্টি হয় নারীর প্রতি সহিংসতা। সমাজে সহিংসতা, বৈষম্যের চেহারা বহুমাত্রিক। সারা পৃথিবী জুড়েই নারীর ওপর সহিংসতা চলছে। মূলত পুরুষদেরকেই এজন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু আমি কখনোই বিশ্বাস করি না যে একজন পুরুষ নিপীড়ক বা সহিংস হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এই সমাজ ব্যবস্থা একজন নিপীড়ক তৈরি করে। তাই আজকের দিনে সমতার সমাজের জন্য সংগ্রাম একই সঙ্গে নারী ও পুরুষের যৌথ সংগ্রাম। ২৪ এপ্রিল এই সংগ্রামী মানুষটির জন্মদিন। এবার কমলার মতাদর্শের সহযোগীরা বাংলাদেশে তার ৭০ তম জন্মদিন পালন করছেন। বিশাল এই মানুষটির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)