চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘এই যুদ্ধে আমাদের সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে’

এম ওসমান সিদ্দিকি ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফিজিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, হাফিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক একটি কলামে তিনি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘যখন আমি (রাষ্ট্রদূত হিসেবে) শপথ গ্রহণ করি, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে সমুন্নত রাখা ও রক্ষা করার জন্য, তখন আমার হাত ছিল কুরআনের উপর যা কিনা আমার স্ত্রীর বাইবেলের উপর রাখা ছিল। এটি ছিল আমার জীবনের সব থেকে গর্বিত সময়গুলোর একটি।’ সেখানে তিনি অভিবাসন, নিজের পছন্দে আমেরিকান হওয়া, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং এরকম আরও নানা বিষয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন।

# আপনি কি আমাদের বলবেন যে কোন জিনিসটি আপনাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট করেছে এবং কি আপনাকে একজন আমেরিকান হতে উদ্বুদ্ধ করেছে?
আমি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার সময় এই দেশে একজন ছাত্র হিসেবে আসি, সে সময়টা ওই অঞ্চলের মানুষদের জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং বিপর্যস্ত একটি সময় ছিল। আমি বাংলাদেশের ঢাকায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করি এবং ইন্ডিয়ানার ব্লুমিংটনে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি স্কুল অব বিজনেস এ ভর্তি হই। ১৯৭৪ সালে আমি এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করি।

শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ভালো। আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপক পরিসরে চিন্তা করার ও তাদের মেধাকে নিজেদের আগ্রহের বিষয়ে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। আমেরিকা সবসময়ই পৃথিবীর সব জায়গার মানুষের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আমাদের স্বাধীনতা, সুযোগ সুবিধা ও বহুতত্ত্ব আমাদেরকে সকলের থেকে পৃথক করে দিয়েছে। আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার একটি জীবন্ত দলিল।

আমেরিকায় আসার পেছনে আমার কারণ আমার আগে আসা অন্যান্যদের কারণের থেকে ভিন্ন নয়। অন্যান্য অনেক অভিবাসীদের মতই আমিও আমেরিকান ড্রীম এর পেছনে ছুটেছি এবং নানাভাবে এই স্বপ্ন পূরণ হতে দেখেছি। আমেরিকাতে আপনি যদি পরিশ্রম করেন আর নিয়ম মেনে চলেন তাহলে আপনার স্বপ্ন ধরা দেবেই। এটি আমেরিকার যাদু, আমেরিকার অলৌকিকতা, এবং হ্যাঁ, শুধু আমারিকাতেই এটি সম্ভব!

# আপনার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি কিভাবে দেশটিকে শক্তিশালী করছে, এবং আমেরিকার আদিবাসী, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত বিভিন্নতা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধকে প্রকাশ করে?
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অধিকতর ভাল জীবনের প্রত্যাশায় অভিবাসীদের দেশ হিসেবে আমেরিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমাদের এমন বহু অভিবাসী আছেন যারা বিভিন্ন অঙ্গনে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কলা, খেলাধূলা, প্রযুক্তি ইত্যাদি ছাড়াও আরো অনেক বিষয়েই তার খুব ভালো করছেন। অনেক অভিবাসীদের মধ্যে কিছু নাম যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন, এলিজাবেথ টেইলর, প্যাট্রিক ইউইং এবং সাত্যা নাদেলা – আমাদের জাতির উৎকর্ষে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।

আমাদের সংবিধানে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের উপর ভিত্তি করে অভিবাসনে কোনো নিষেধ নেই। এটিই আমেরিকান মূল্যবোধের প্রধান ভিত্তি। আপনার পরিবারের শেকড় বা বংশ পরম্পরা পৃথিবীর যেখান থেকেই আসুক না কেন, আপনি আমেরিকান হতে পারবেন।

আমরা একটি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল জাতি, আমরা সবসময়ই অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছি। তবে কিছু নিয়ম কানুন তো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহিত করতে পারি না, এবং এমন কাউকে অভিবাসন দিতে পারি না যার অপরাধের ইতিহাস আছে বা যার এই দেশে অভিবাসনের জন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে।

# একজন আমেরিকান মুসলিম হিসেবে আপনার দৃষ্টিতে ইউএস সমাজে মুসলিমদের কোন অবদানটির কথা আমাদের পাঠকদের জানা দরকার?
আমেরিকান মুসলিমদের বর্তমান সংখ্যা ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন হলেও এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে দ্রুত বিকাশমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আমরা এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই জাতির উন্নতিতে আমরা সবসময়ই অবদান রেখে চলেছি। আজ বিজ্ঞান, ব্যবসা, খেলাধূলা, রাজনীতি, সংগীত এবং আরো অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকান মুসলিমরা সফলতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে।

সিদ্দিকী পরিবার

বিখ্যাত বহুতল ভবন সিয়ারস টাওয়ার একজন আমেরিকান মুসলিমের নকশায় তৈরি হয়েছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ৩,৫০০ জন আমেরিকান মুসলিম আছেন, আমাদের দু’জন কংগ্রেস সদস্য, বহু স্টেট লেজিসলেটর (আইন প্রণেতা), মেয়র, কাউন্সিল মেম্বার এবং পুলিশ অফিসার আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করেছেন।

অনেকের মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়া কিছু নাম হলো, মোহাম্মদ আলী (সাবেক বক্সিং চ্যাম্পিয়ন), আইস কিউব (র‌্যাপ শিল্পী ও প্রযোজক), মোহাম্মাদ আল-এরিয়ান (ব্যবসায়ী ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ), আহমেদ জিউয়ালি (রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত), মোনা এল্টাহাউই (সাংবাদিক), শিভা বালাঘি (ঐতিহাসিক ও ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যক্ষ), কারিম আব্দুল-জাব্বার (সাবেক বাস্কেটবল তারকা), ফারিদ জাকারিয়া (সাংবাদিক ও টিভি তে টক শো এর উপস্থাপক), মেহমেট ওজ (ডাক্তার ও টিভি উপস্থাপক), কিথ এলিসন (ইউএস কংগ্রেসম্যান)।

# আপনার নিজের অবদান সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন। কোন বিষয়টি আপনাকে কূটনৈতিক কাজে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে? আপনার কোন অর্জনটির (ব্যাক্তিগত বা পেশাগত বা দুটোই) জন্য আপনি সবচাইতে বেশি গর্বিত এবং কেন?
আমার ব্যবসায় শিক্ষা শেষে আমি ওয়াশিংটনে চলে আসি একটি বড় ফরচুন ৫০০ নামক কম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি (ব্যাবস্থাপনা শিক্ষানবিশ) হিসেবে কাজ নিয়ে। খুব দ্রুতই আমি অনুভব করলাম যে আমি আসলে নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করে আমার আমেরিকান ড্রিম অনুসরণ করতে চাই, আমার নিজের উদ্যোক্তা হিসেবে যে প্রশিক্ষণ আছে এবং যে আগ্রহ আছে সেটিরও তাতে পরীক্ষা হয়ে যাবে। আমি বহু কোম্পানিকে সফলভাবে গোড়া থেকে শুরু করেছি, যেখানে শত শত লোক কাজ করে এবং এভাবে এই অঙ্গনে আমি নিজের অবদান রেখেছি।

ব্যবসায় ভালো করার পাশাপাশি আমি সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে এবং জাতীয় রাজনীতিতেও আগ্রহী ও সক্রিয় হয়ে পড়ি। একজন ইউএস রাষ্ট্রদূত হতে পারা অত্যন্ত সম্মান ও আনন্দের, এবং আমি নিজের দেশের জন্য কাজ করার এই সুযোগটি পেয়ে কৃতজ্ঞ। এটি যে দেশ আমাকে এত কিছু দিয়েছে তাকে কিছু ফেরত দেয়ারও একটি উপায়।

আমার পরিবার, আমার কাজ ও আমার দেশ আমার হৃদয়ের সবচাইতে কাছের অংশ।

# আপনি কি অন্যান্য দেশের মুসলিমদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য উৎসাহিত করবেন, বেড়ানোর জন্য বা অভিবাসী হিসেবে?
আমেরিকানরা সাধারণত খুব সহনশীল, উদার ও অমায়িক মানুষ।

তুলনামূলকভাবে তরুণ একটি জাতি হিসেবে আমাদের উন্নয়ন এখনও চলমান একটি প্রক্রিয়া। আমাদের আদি ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আমরা নাগরিক অধিকার, নারীদের অধিকার ও সর্বোপরি মানবাধিকার নিয়ে বিশাল কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি।

বিশ্বে আনুমানিক ১৬০ কোটি মানুষ মুসলিম এবং ৫৭টি মুসলিম প্রধান দেশ রয়েছে। আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংঘ ও চুক্তিতে অনেক মুসলিম দেশ আমাদের সাথে অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বিশ্বায়নের পৃথিবীর পূর্বশর্ত হচ্ছে আমাদের মুসলিম বন্ধুদের ভ্রমণ ও যোগাযোগের স্বাধীনতা।

রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকী এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন

যে কারো আমাদের ভিসা ও নিরাপত্তার নিয়ম মেনে শর্ত পূরণ করলে আমাদের দেশে প্রবেশাধিকার পাওয়া উচিত। মুসলিমরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

# ইদানিং অনেকেই স্বঘোষিত মুসলিম জিহাদিদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে আতংকিত থাকেন। আপনার মতে আমেরিকান মুসলিমদের কী বিশেষ দায়িত্ব আছে এই ধর্মীয় বিশ্বাসের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সৃষ্ট চরমপন্থী মতাদর্শকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে?
অনেক উচ্চ পর্যায়ের সন্ত্রাসী হামলায় ইসলামি জিহাদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, অথচ কুরআনে স্পষ্টভাবে নিষ্পাপ মানুষ হত্যাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। এই সন্ত্রাসীরা মুসলিম নয়, এরা সাধারণ খুনী যারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র দলের হয়ে ইসলামকে ব্যবহার করছে। তবে, এই ঘটনাগুলো সব মুসলিমের ওপর একটি অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, নিজেদের বাড়িঘর, মসজিদ ও সমাজের প্রতি একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে যাতে কোন মৌলবাদী উপাদান না থাকে।

তবে একই সাথে মনে রাখতে হবে, এইসব ঘটনার জন্য সকল মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব বা ঘৃণা পোষণ করাও কোনো সহায়ক ভূমিকা রাখবে না। আমরা আপনাদেরই পড়শি, আপনার সহকর্মী, আপনার বন্ধু ও আপনার পরিবারের সদস্য।

# সবশেষে, আপনি সকল আমেরিকানের উদ্দেশ্য – মুসলিম হোক বা অন্য কোনো ধর্মের – সন্ত্রাসের হুমকির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কীভাবে আহ্বান জানাবেন?
এই আতংক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের ধর্ম, বর্ণ, বংশ নির্বিশেষে সকল আমেরিকানদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে। কোন ধর্মই নিষ্পাপ মানুষ হত্যার পক্ষে না। সাধারণ মানবতাবোধ এবং আমাদের সংবিধানই আমাদের সবার জন্য দিক নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।

আজকের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আমরা সত্যিকারের বিপদ ও হুমকির সম্মুখীন। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার এই সমস্যাগুলো কোনো ধর্মকে ছোট করে বা ধর্মের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে সমাধান করা সম্ভব নয়। এই যুদ্ধে আমাদের একত্রে অংশগ্রহণ করতে হবে, আর শুধু এভাবেই জেতা সম্ভব।