চার বছর আগে প্রায় এইদিনেই কলম্বিয়াকে হারিয়ে ঘরের মাঠে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিল ব্রাজিল। সেই ম্যাচে উল্লাসের বদলে ব্রাজিলিয়ানদের চোখে-মুখে ছিল বেদনার ছায়া। কারণ কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার হুয়ান জুনিগার ভয়ঙ্কর এক ফাউলে ক্যারিয়ারটাই শেষ হতে বসেছিল নেইমারের। সেবারের স্বাগতিকদের তারকা এ ফরোয়ার্ড পরে সেমিতে খেলতে পারেননি। পরের ইতিহাস তো প্রায় সবারই জানা। মিনেইরোতে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হয় সেলেসাওরা!
শুক্রবার বেলজিয়ামের ম্যাচে নেইমারের দুর্ভাগ্য ফিরে এলো আবারও! এবার অবশ্য চোটে পড়েননি। তবে দল ছিটকে গেছে বিশ্বকাপ থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেনও থাকলেন নিজের ছায়া হয়ে। মাঠে কয়েকবার তর্জন-গর্জন অবশ্য করলেন। দু-একবার গড়াগড়িও খেলেন। কিন্তু বেলজিয়ান রক্ষণ লাইন ভাঙতে পারলেন না। আর পারলেও থিবো কোর্তোয়া নামের দেয়ালের কাছে আটকে যেতে হল।
শুক্রবার মাঠে ছিলেন আরেকজন নাম্বার টেন। কলম্বিয়াকে হারিয়ে যেবার সেমি নিশ্চিত করল ব্রাজিল, পরেরদিন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঠে নামতে হয়েছিল তার দলকেও। তিনি এডেন হ্যাজার্ড। সেবারও অনেক ভরসা ছিল তার উপর। বেলজিয়ান নাম্বার টেন তখন পারেননি। ফলশ্রুতিতে, সমালোচনায় ধুয়ে দেয়া হয় তাকে।
ব্রাজিলের বিপক্ষে গতবারের আর্জেন্টিনা ম্যাচের আটজন ফুটবলার ছিলেন। কাজানে সেই আটজনের সঙ্গে নতুনদের নেতৃত্ব দিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হয় হ্যাজার্ডকে। তাতে অন্যরকম এক বেলজিয়ামকেই দেখছে ফুটবল বিশ্ব। সেলেসাওদের বিপক্ষে যুদ্ধের সেনানায়কের মতই লড়লেন চেলসি ফরোয়ার্ড। দেশকে নিয়ে গেছেন ৩২ বছর পর বিশ্বকাপের সেমির মঞ্চে। তাতে ঢাকা পড়ে গেলেন ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেন নেইমার।
দুজনের জার্সিই নাম্বার দশ। দুজনেই নেতা, দলের প্রাণভোমড়া। সেটি পারফরম্যান্সে। পার্থক্য শুধু গত ম্যাচে একজনের বাহুতে ছিল আনুষ্ঠানিক আর্মব্যন্ড, আরেকজনের ছিল না। কাজানের ম্যাচে পরে দুই নেতার পার্থক্যটা বড় হয়েই ধরা দিল। এগিয়ে থাকলেন হ্যাজার্ড। নেইমারও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু কাজের কাজটা করতে না পারায় তিনি ট্র্যাজেডির নায়ক।
বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত কেভিন ডি ব্রুইনকে মনে করা হচ্ছিল বেলজিয়ানদের আসল নেতা। কিন্তু প্রকৃত মঞ্চে হ্যাজার্ডই প্রমাণ করে দিলেন, কেন তার হাতে পরিয়ে দেয়া হয়েছে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। অথচ ব্রাজিলের বিপক্ষে গোল কিংবা গোলে অ্যাসিস্ট কোনটাই করেননি। তারপরও তাকে দেখে মনে হয়েছে রাজা মাঝ মাঠে দৌড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুদ্ধে।
অন্যদিকে নেইমারকে দেখুন। পুরো সময়েই খেলেছেন। বেলজিয়ান ডি-বক্সে পড়ে গিয়ে দুবার পেনাল্টির আবেদনও করলেন। রেফারি বাঁশি বাজালেন না। তবে কী সেটা আগের ম্যাচগুলোতে নাটকের ফল? ম্যাচের শেষপর্যন্ত গোলে শট নিয়েছেন। থিবো কোর্তোয়া না হয়ে অন্যকোন গোলরক্ষক হলে হয়ত কাঙ্ক্ষিত গোলটাই পেয়ে যেতেন পিএসজি ফরোয়ার্ড।
মেসি-রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতেই বিশ্বকাপে এসেছিলেন নেইমার। সেই সুবর্ণ সুযোগটাও ছিল তার সামনে। কিন্তু সুযোগের সঠিক ব্যবহারটা করা হয়ে উঠল না। মেসির ছায়ায় থাকতে চান না বলে বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন! তবে কী প্যারিসে পাড়ি জমানোটাই নেইমারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল?
লা লিগার মতো প্রতিযোগিতাপুর্ণ এক লিগ ছেড়ে লিগ ওয়ানে খেলতে যাওয়াই কি কাল হয়ে দাঁড়াল ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেনের জীবনে? তার উপর বারবার ডাইভ দেয়ার মতো নাটক করে ভক্তদের ক্ষেপানো, নেইমারের পাশে যে বড্ড বেমানান! মেসি-রোনালদোর কাতারে যেতে হলে তাকে অবশ্যই তাকেই এ স্বভাব ত্যাগ করতে হবে।
আশার কথা হল, মহাতারকা হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে নেইমারের হাতে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে নেইমারের বয়স হবে ৩০। থাকছে সম্পূর্ণ সুস্থ্য থেকে আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগও। আর হ্যাজার্ডের সামনে এখনই সুবর্ণ সুযোগ। মঙ্গলবার ফ্রান্সের নাম্বার টেন কাইলিয়ান এমবাপেকে থামিয়ে দিতে পারলেই স্বপ্নের থেকে মাত্র একধাপ দূরে থাকবেন ২৭ বছর বয়সী বেলজিয়ান অধিনায়ক।
ইএসপিএন ফুটবলে লেখা জয়াদিত্ত গুপ্তের প্রবন্ধ অবলম্বনে