ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীভূত (সেন্ট্রালাইজড) না রেখে কিছুটা বিকেন্দ্রীভূত (ডিসেন্ট্রালাইজড) করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম)।
দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শাখা পর্যায়েও ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সুযোগ দিলে খেলাপির ঝুঁকি কমে আসতে পারে। তবে এতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ যেন অনিয়মে না জড়াতে পারে সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে।
বিআইবিএম-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএমে আয়োজিত সেমিনারে এ বিষয়ে ‘সেন্ট্রালাইজড অ্যান্ড ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যাংকিং: এ স্টাডি অব দি রিস্ক রিটার্ন প্রোফাইল অব ব্যাংকস’ ও ‘গভর্মেন্ট স্পেন্ডিং অ্যান্ড সোসিও-ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ইন নামিবিয়া’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের কেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার কারণে প্রধান কার্যালয়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। যা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঝুঁকি বাড়ায়। শাখা পর্যায়ে ক্ষমতা কিছুটা বাড়িয়ে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সুযোগ দিলে খেলাপির ঝুঁকি কমে আসবে। কিন্তু সীমাহীন ক্ষমতা দিলে এর অপব্যবহার হতে পারে। তবে কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের চেয়ে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি কমাতে এবং মুনাফা অর্জনে সুশাসন অতি জরুরি।
সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রিফর্মস অ্যাডভাইজর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, সেন্ট্রালাইজড এবং ডিসেন্ট্রালাইজড উভয় পদ্ধতির একটি যোগসূত্র রয়েছে। বাংলাদেশে যেটি ব্যবহৃত হয়, সেটি হলো, বড় ধরনের ঋণ, সম্পদ দায়বদ্ধতা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সেন্ট্রালাইজড (হেড অফিস) হয়। কিন্তু কিছু কিছু সেবার মান উন্নয়নে ডিসেন্ট্রলাইজেশনেরও (বিকেন্দ্রীয়করণ) প্রয়োজন রয়েছে। এতে নতুন নতুন উদ্ভাবন তৈরি হবে, কর্মকর্তাদের মেধার বিকাশ ঘটবে, শাখা পর্যায়ে নিজেরা ক্ষমতাবান হবে।
এছাড়াও এসএমই, কৃষি, নারীর ঋণ, নারীর ক্ষমতায়ন, এমএসএমই, সিএসএমই ঋণ বিতরণের ক্ষমতা দেওয়ার কারণে গ্রামের মানুষ ঋণ পাচ্ছেন।
এস কে সুর চৌধুরী বলেন, তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে ডাটা সেন্টারের মাধ্যমে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সুষ্ঠু সমন্বয় গড়ে তোলা গেলে শাব্দিক এবং পদ্ধতিগত ব্যাংকিংয়ের সুবিধা পাওয়া যাবে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, শাখার মাধ্যমে সেবা প্রদানের কোনো রেকর্ড শাখায় থাকছে না। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো অডিট কোম্পানি ইন্সপেকশনে যায়, তখন শাখা জানায় যে, তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরামর্শক বলেন, আমাদের পরামর্শ হচ্ছে সেন্ট্রালাইজড এবং ডিসেন্ট্রালাইজড দু’টোই চালু থাকবে। এতে বড় ঋণগুলো হেড অফিসের সিদ্ধান্তে বিতরণ করতে হবে। ছোট ঋণগুলো শাখা ম্যানেজারই দিতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে সততা, স্বচ্ছতা, হিসাবায়ন ও পরিদর্শনের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যেন ডাটা ট্রান্সফরমেশনের কোনো জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংক যেন অসুবিধার সম্মুখীন না হয়।
তিনি আরও বাংলাদেশে আশির দশকে সেন্ট্রালাইজড ব্যাংকিং ছিল। পরবর্তীতে দেখা গেলো সেন্ট্রালাইজড ব্যাংকিংয়ে সেবাটা খুব বিস্তৃত করা যাচ্ছে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যাংকিং শুরু করা হলো। তার ফলে রিজিওনাল অফিস, জোনাল অফিস ও শাখা ব্যবস্থাপকের ক্ষমতা দেওয়া হলো।
আবার ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এতে ব্যবসা প্রসারিত হয়, ব্যবসার প্রসারে ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধি পায়। এখানে একটি সমস্যা আছে গ্রাহককে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। বড় ঋণ খেলাপি হতে পারে। এতে কর্মকর্তাদের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিআইবিএম’র চেয়ার প্রফেসর ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, ক্রমেই ব্যাংকের বিজনেস মডেল পরিবর্তন হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকের সেবার ওপর নির্ভর করবে কোন ধরনের পদ্ধতি উপযুক্ত।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এ চৌধুরী বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সেবা প্রদান করা হয় বিকেন্দ্রীয়ভাবে। এ বিষয়ে বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যা পুরো ব্যাংকিং খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহজ হবে।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাতে কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ উভয় পদ্ধতি রাখতে হবে। কিন্তু বিভিন্নভাবে ব্যাংকিং সেবার ওপর নজরদারী বাড়াতে হবে যাতে গ্রাহকরা দ্রুত সব ধরনের সেবা পায়।
ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক উৎপল কুমার দে বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের ব্যয়ের বিষয়টি প্রত্যেক দেশে খতিয়ে দেখলে জনগণ কতটুকু লাভবান হচ্ছে তা বেরিয়ে আসবে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলি বলেন, কিছু সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করলে সেবার মান উন্নত হবে। তবে সম্ভাব্য ঝুঁকি ও প্রভাব বিবেচনায় রেখে তারপর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।