এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
ময়মনসিংহ থেকে: সেয়ানে-সেয়ানে টক্কর আর উত্তেজনায় টইটম্বুর এক রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের সাক্ষী হলেন গ্যালারি ভর্তি দর্শক। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ ও শরীরী আগ্রাসনে ভরা ফেডারেশন কাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ ১-১ গোলের সমতায় নির্ধারিত সময়ের গণ্ডি পেরোয়। অতিরিক্ত সময়ে বসুন্ধরা কিংসের গোলের প্রতিবাদে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠ ত্যাগ ও পরে ফেরার নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণাও ঘটে। খেলা ফের মাঠে গড়ানোর পর ২-১ গোলে ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিতে নিয়েছে কিংস।
স্বাধীনতা কাপ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের পর ফেডারেশন কাপের ট্রফি ঘরে তোলার এক মৌসুমে ট্রেবল জিতল অস্কার ব্রুজনের দল। এটি দলটির ফেডারেশন কাপে তৃতীয় শিরোপা জয়।
ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে বুধবার বিকেল ৩টায় ম্যাচ শুরু হয়। ধীরে ধীরে গ্যালারিতে ভিড় বাড়তে থাকে। শুরুর একাদশে ছিলেন না কিংসের তারকা গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো। সাফের সেরা গোলরক্ষককে বসিয়ে মেহেদী হাসান শ্রাবণকে নামানো হয়।
খেলার শুরু থেকেই দুদলের মাঝে ছড়াতে থাকে উত্তেজনা। শরীরী ভাষা ছিল আক্রমণাত্মক। পঞ্চম মিনিটে মিগুয়েল দামাসেনোকে হালকা ধাক্কা দেন ইমানুয়েল সানডে। খানিক পর সানডেকেও ফাউল করেন দামাসেনো। রেফারির হস্তক্ষেপে উত্তেজনা প্রশমিত হয়।
দশম মিনিটে মিডফিল্ডার আরিফ হোসেনকে বাজেভাবে ট্যাকল করেন কিংসের বিশ্বনাথ ঘোষ। তাতে আবারো উত্তেজনা ছড়ায়। ১৫ মিনিটে ম্যাচের প্রথম কর্নার কিক পায় কিংস। বল লাইনের উপর থাকা সত্ত্বেও লাইন্সম্যান পতাকা উঁচিয়ে ধরেন। দামাসেনোর কর্নার কিকে ফিস্ট করে জাল অক্ষত রাখেন হোসেন সুজন। মিনিট দুয়েক পর আরিফকে ফাউল করায় বিশ্বনাথ দেখেন হলুদ কার্ড।
সোলেমান দিয়াবাতেকে ২২ মিনিটে তপু বর্মণ ফাউল করলে রেফারি বাঁশি বাজান। তপু এতে ক্ষেপে গিয়ে বাদানুবাদে জড়ান। খানিক পর পাল্টা আক্রমণ থেকে রাকিবের পাসে বল নিয়ে ডি বক্সে ঢোকেন ডরিয়েল্টন। সামনে এগিয়ে এসে দুই পা দিয়ে ২৭ মিনিটে দারুণ দক্ষতায় বল ঠেকিয়ে মোহামেডানকে বাঁচিয়ে দেন সুজন।
আক্রমণে কিংস এগিয়ে থাকলেও সাদা-কালোদের জমাট রক্ষণ ভাঙা ছিল কষ্টসাধ্য। রাকিবের কাটব্যাকে ডি বক্সের ভেতরে পাওয়া সোহেল রানা অতি দ্রুত কিক নিতে গিয়ে গড়বড় করে বসলে ৩৭ মিনিটে গোলের দেখা পায়নি কিংস। খানিক পর দামাসেনোর মানব দেয়ালের উপর দিয়ে ফ্রি-কিক নিলেও ঝাঁপিয়ে পড়ে বল ধরেন সুজন।
আক্রমণে ওঠা সানডেকে খানিকপর পেছন থেকে ফাউল করেন বিশ্বনাথ। আগেই হলুদ কার্ড পাওয়া এ ডিফেন্ডার লাল কার্ডের ঝুঁকিতে পড়েন। রেফারি পকেটে হাত দিলেও কার্ড না দেখানোয় মোহামেডানের খেলোয়াড়রা ক্ষেপে যান, ডাগ আউটে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সাদা-কালোরা ৪১ মিনিটে এসে পায় সুবর্ণ গোলের সুযোগ। দিয়াবাতের পাসে বল পাওয়া সানডের শট বিশ্বনাথের শরীরে লেগে পোস্টের উপর দিয়ে চলে যায়। দুই মিনিট পর আরিফের ক্রসে বল নিয়ে শট নেন দিয়াবাতে। যদিও বল ধরে ফেরেন শ্রাবণ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ৪৯ মিনিটে তপুর বাড়ানো পাসে ডরিয়েল্টন অ্যাক্রোবেটিং শট নিতে গিয়ে পায়ে ঠিকঠাক বলের সংযোগ ঘটাতে পারেননি। গোলের দারুণ সুযোগ হারায় কিংস।
মাহবুবের বাড়ানো বল ডি বক্সে থাকা দিয়াবাতে ৫৫ মিনিটে লক্ষ্যভেদের সুযোগ পান। শেষ মুহূর্তে গফুর বেগ বল বিপদমুক্ত করেন।। এর পরপরই মেহেদী হাসানের শট পোস্টের উপর দিয়ে যাওয়ায় গোল হজম করেনি কিংস।
আরিফের জায়গায় ৫৯ মিনিটে মাঠে শাহরিয়ার ইমন নামেন। তাতে আচমকা পাল্টে যায় মোহামেডান। খানিক পর ৬০ মিনিটে ইমনের শট কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান শ্রাবণ। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মোজাফফরফের শট কিংস গোলরক্ষক রুখে দেন। দিয়াবাতের হেডও প্রতিহত করে জাল অক্ষত রাখেন শ্রাবণ।
একের পর এক আক্রমণ গড়তে থাকা মোহামেডান ৬৩ মিনিটে ডেডলক ভাঙে। গফুর বেগ ও সোহেল রানাকে পরাস্ত করে ইমানুয়েল সানডের ডানপায়ের দূরপাল্লার শটে নিশানাভেদে সাদা-কালোরা এগিয়ে যাওয়ার উৎসবে মাতে।
কিছুপর দামাসেনোর শট নেয়ার পর হেড করতে পারেননি গফুর। তার সঙ্গে সংঘর্ষে চোট পান সুজন। ৭১ মিনিটে সানডের পাসে দিয়াবাতের শট ঠেকান কিংস গোলরক্ষক। কিংসের হয়ে খেলতে নামেন সোহেল রানা, সোহেল রানা জুনিয়র ও রিমন। তিন পরিবর্তনের পরপরই সানডেকে আক্রমণে ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দেয়ায় হলুদ কার্ড দেখেন তপু বর্মণ।
সমতায় ফিরতে মরিয়া কিংসের অধিনায়ক রবসনের পাসে ডরিয়েল্টনের শট ৭৭ মিনিটে সুজন ঠেকান। কর্নার কিকও ফিস্টে ফেরান মোহামেডান গোলরক্ষক। পাল্টা আক্রমণে ইমনের পাসে অনেকটা দৌড়ে যাওয়া মিনহাজ রাকিবের ক্রস কিংসের এক খেলোয়াড় কর্নারের বিনিময়ে বিপদমুক্ত করেন।
খেলার ৮১ মিনিটে ঘটে নাটকীয় ঘটনা। রবসনের বুলেট গতির শট সুজনের হাতে লাগার পর তা পোস্টে লেগে ফেরে। আকস্মিক পাল্টা আক্রমণে যাওয়া দিয়াবাতের শট সামনে এগিয়ে পা দিয়ে ঠেকান শ্রাবণ। তিন মিনিট পর বড় সুযোগ পেয়েও সুজনের দৃঢ়তায় সাফল্য পাননি রবসন।
৮৭ মিনিটে একক প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের চার খেলোয়াড়কে কাটিয়ে দূরপাল্লার কিকে কিংসকে সমতায় ফিরিয়ে ফাইনাল জমিয়ে তোলেন দামাসেনো। জার্সি খুলে উদযাপন করায় রেফারি তাকে দেখান হলুদ কার্ড। যোগ করা সময়ের চতুর্থ মিনিটে সানডের শট শ্রাবণ প্রতিহত করায় ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ফাইনালে ছড়ায় রোমাঞ্চ।
দামাসেনো ৯৫ মিনিটে ডি বক্সের কাছে ফাউলের শিকার হলে ফ্রি-কিক পায় কিংস। রবসনের শট মানব দেয়ালের বেশ উপর দিয়ে চলে যায়। হোসেন সুজন ১০৫ মিনিটে আবারো মোহামেডানের ত্রাতা হন। রবসনের দুরন্ত শট কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান।
তারপর দামাসেনোর কর্নার কিকে বল সুজনের হাত ফসকে যায়। সুযোগ সন্ধানী মিডফিল্ডার জাহিদ হোসেন বল জালে জড়ালে কিংস লিড পায়। তবে ফাউলের অভিযোগে মোহামেডানের খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের সবাই রেফারিকে ঘিরে ধরেন। গ্যালারিতে দুদলের সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যদিও টিভি রিপ্লেতে দৃশ্যত সেটিকে গোল বলেই মনে হয়েছে।
মোহামেডান কোচ আলফাজ আহমেদের ডাকে সাড়া নিয়ে দলের খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়েন। দর্শকদের বোতল ছোঁড়ার এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে বসুন্ধরার খেলোয়াড়দের দিকে বোতল ছুঁড়ে বসেন সুজন। কিছুপর কিংসের এক খেলোয়াড় দর্শকদের দিকে বোতল ছুঁড়লে তা প্রেসবক্সের কাছে এসে পড়ে। ১৫ মিনিট পর মোহামেডানের ফুটবলাররা মাঠে নামলে খেলা আবারো শুরু হয়।
দিয়াবাতেকে ফাউল করা নিয়ে কিংসের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে মোহামেডানের ডাগ আউটে থাকা সবার তর্ক শুরু হয়। খেলা অল্প সময়ের জন্য আবারো বন্ধ থাকে। মোরসালিন ১১৬ মিনিটে ফাউলের শিকার হলে রেফারি বাঁশি বাজিয়েও কিংসের ফুটবলারদের হাত থেকে রেহাই পাননি। কেন হলুদ কার্ড বের করেননি, সেজন্য চড়া মেজাজে কথা বলেন রবসন।
সানডের পাসে ইমনের শট ১২০তম মিনিটে একদম পোস্ট ঘেঁষে গেলে হতাশ হয়ে পড়ে মোহামেডানের ডাগ আউট। পরের মিনিটে মোজাফফরফের শট পোস্টের সামান্য উঁচু দিয়ে বেরিয়ে যায়।