বুথফেরত জরিপ বলেছিলো, ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে ১৮০ থেকে ২১০ আসনের জয় পেতে পারে বিজেপি। বলা চলে, সে জরিপের চেয়েও শতাধিক আসন বেশি পেয়েছে মোদির দল। কেন এই অভাবনীয় জয়। তা নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সবখানে।
দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর প্রদেশে ঘুরেফিরে ক্ষমতার অংশ ছিলো যাদব পরিবার আর মায়াবতীর দল। নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগেও পিতাপুত্রের দ্বন্দ্ব রাজ্যভিত্তিক রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুলায়াম-শিবপাল শিবিরের মূল আপত্তি ছিলো কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা নিয়ে। অবিভক্ত উত্তর প্রদেশে ৮০ সালে কংগ্রেস ৩০৯ আসন পেয়েছিলো। ৩৭ বছর পরে আবার ৩শ র বেড়া টপকে উত্তর প্রদেশের কুর্সি দখলে করলো কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ। পাশাপাশি বাড়তি পাওনা উত্তরাখন্ডের জয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ভেনকাইয়া নাইডুতে রীতিমতো ঘোষণাই দিয়েছেন, এই জয়ের বার্তা স্পষ্ট তাহলো মোদির প্রতি জনআস্থা। তার মতে, পুরো জাতি আজ মোদির ওপর আস্থাশীল। কারণ মোদি মানেই ভারতের উন্নয়ন। মোদি মানেই কৃষকের উন্নয়ন চিন্তা। যেহেতু উত্তর প্রদেশ অনেকটাই প্রত্যন্ত এলাকা। এখানকার যুবকরা কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত অন্যত্র চলে যান, তাই বিজেপির ইশতেহার ছিলো এসব বেকারকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া। এসব কারণেই ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যটিতে বিজেপির এমন অভাবনীয় জয়। কেন্দ্রের আরেক মন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, ২০১৪ তে লোকসভায় বিজেপির পক্ষে ৪০ ভাগ সমর্থন মিলেছিলো উত্তর প্রদেশ থেকে। এবার সে হার প্রায় ৮০ ভাগ।
অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতা রণদীপ সূর্যিওয়ালা, মোদি-অমিত শাহকে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি ঘোষণা দিয়েছেন, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডে আগামী দিনে বিজেপির কর্মকাণ্ডে চৌকিদারি করবে তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অখিলেশ যাদব-রাহুল গান্ধি জোটের এই পরাজয়ের প্রভাব পড়বে পুরো ভারতের রাজনীতিতে।তার ঢেউ আছড়ে পড়বে হয়ত সীমান্তের ওপারের মানুষদের ওপরও।
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়তে পারে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির উপরও। বিশেষ করে গেল বছরের সেপ্টেম্বরে, উরি হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছাড়া আর কোন কড়া পদক্ষেপ নেননি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নোট বাতিল ইস্যুতেও দেশজুড়ে মোদির ওপর ক্ষোভে ফুঁসছিলো সাধারণ মানুষ। অনেকে বলছেন, এতদিন শুধু উত্তরপ্রদেশের মতো বৃহৎ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন মোদি। সাধারণ মানুষের মনোভাব উপলব্ধি-ই ছিলো তার প্রধান চ্যালেঞ্জ। উত্তর প্রদেশের এই নির্বাচনে, মোদির প্রতি ৮০ ভাগ মানুষের সমর্থন-ই বলে দিচ্ছে, এখনও তিনিই তাদের কাছে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা। বিজেপি প্রধান অমিত শাহ তো বাড়িয়েই বলেছেন, ভারতের স্বাধীনতার পর এযাবত সবচেয়ে আস্থার রাষ্ট্রনেতার নাম শ্রী নরেন্দ্র মোদি।
উত্তর প্রদেশে তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বুঝে গিয়েছেন, নোট বাতিলের সুফল যে আদতে গরিব মানুষই পাবে, সেটা আঁচ করতে পেরেছে জনগণ। তাই এখন ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে যেকোন পদক্ষেপ নিলেও তাতে যে জনগণ সায় দেবে, এটা বলাই যায়। কারণ রাজনীতির মাঠে মোদির সমকক্ষ এই মুহূর্তে দ্বিতীয়জন নেই। বিশেষ করে কোন মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছাড়াই বিজেপি স্রেফ মোদির ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগিয়েই লক্ষ্ণৌর মসনদ দখল করলো ঐতিহাসিকভাবে। গেল বছর নোট বাতিল ইস্যুতে, বিরোধী দল কংগ্রেস কিংবা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, মোদির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো। সেবার রাজনাথকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে মোদির প্রতি আহবানও জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। অবশ্য অনেকে বলছেন, উত্তর প্রদেশের এই জয় মোদির ইমেজকে আরো চাঙ্গা করেছে। বিশেষ করে জুলাইয়ে ভারতের নতুন প্রেসিডেন্ট চূড়ান্ত করতে বিজেপি এখন নিজেদের প্রার্থীকে সামনে আনতে পারবে। সেক্ষেত্রে বিরোধীদের মত কতটা গুরুত্ব পাবে সেটাই দেখার বিষয়। এছাড়া ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনেও মোদির এই ব্যাক্তি ইমেজ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে দেখা দেবে।
শুধু পাকিস্তানকে চাপে রাখার কৌশলই নয়, বাংলাদেশ নীতিতেও বেশ কিছু রদবদল আনতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। আগামী মাসেই ভারতে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধারণা করা হচ্ছে এবারের সফরে জঙ্গি তথ্য আদানপ্রদান ও দুদেশের সাংস্কৃতিক সর্ম্পক জোরদার হবে ভারত-বাংলাদেশের। এমনটাই মত পর্যবেক্ষকদেরও।
গেল বছর কাশ্মির ইস্যুতে ইসলামাবাদের সাথে নয়াদিল্লির যে দূরত্ব বেড়েছে, পণ্ড হয়েছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজনও। ভারত-পাকিস্তানের উত্তাপের রেশ ছিলো গোয়ায় বিমসটেক সম্মেলনেও। পাকিস্তানকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেন মোদি। সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের আযাদ কাশ্মির অভ্যন্তরে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, সিন্ধু জলচুক্তি পর্যালোচনার পর এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেন মোদি। নির্বাচনী প্রচারেও মোদি একাধিক জনসভায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গ তুলেছেন। বিপুল হাততালিও পেয়েছেন। এও মনে করা হচ্ছে, পাক শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা বলতেও মোদিকে এই জয় বিশেষ সাহায্য করবে। নেপালের মতো রাজনৈতিকভাবে অশান্ত দেশের সঙ্গেও নতুন করে আলোচনা শুরু করতে পারে ভারত।
এবারের নির্বাচনে মায়াবতী ৭০ মুসলিম প্রার্থী দিয়েও সংখ্যালঘু ভোট টানতে পারেননি। গড়ে ১০ ভাগ মুসলিম ভোট পড়েছে বিজেপির ব্যালটে। অবশ্য, উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির যে ইশতেহার তাতে নতুন করে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ ইস্যুকে সামনে এনেছে। নব্বইয়ের দশকে বাবরি মসজিদ ভাঙা ইস্যুতে এরই মধ্যে আদালতের কাঠগড়ায় বিজেপির শীর্ষ নেতা আদভানিসহ ১৩ জন। নিম্ন আদালতের রায়ে তারা খালাস পেলেও, সর্বোচ্চ আদালত বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙার দায় এড়াতে পারে না বিজেপির এই নেতারা। উত্তর প্রদেশে যেহেতু সব ধর্ম বর্ণের মানুষের সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে মোদির দল। ধারণা করা হচ্ছে, রামমন্দির নির্মাণের মতো কর্মসূচি হাতে নিলে আবারও সহিংসতা ছড়াতে পারে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যটিতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)