এবছর ঈদে কেনাবেচা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ঈদের চেয়ে এবছর কেনাবেচা অনেক বেশি হয়েছে। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে। যার বেশির ভাগই খরচ হয়েছে ঈদের কেনাকাটায়। দেশে সারাবছর যে পরিমাণ ব্যবসা হয় তার অর্ধেকেরও বেশি হয় ঈদের সময়। তাই এই সময়টাই অর্থনীতির চাকা সচল হয় সবচেয়ে বেশি।
পুরো একটি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা হয়ে থাকে রোজার ঈদকে সামনে রেখে। তবে এবারের কেনাবেচা নিয়ে ভিন্ন মত দিয়েছে বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের কেউ বলছেন এই ঈদে কেনাবেচা কমেছে। আবার কেউ বলছেন, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার কেনাবেচা বেশি হয়েছে।
ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আজাহারুল হক আজাদের মতে, এইবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে কেনাকাটা তুলনামূলক কমই হয়েছে। ‘এই বছর বেচা-কেনা নিয়ে সবার প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিলো। কারণ এবার গতবারের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নেই দেশ। তাই প্রত্যাশাও ছিলো বেশি। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’
তবে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের সংগঠনের করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঈদুল ফিতরের উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজারে লেনদেন হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে দৈনিক লেনদেন ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ঈদের আগে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে; তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, ঈদের এবারের কেনাবেচা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ তার ‘উৎসবের অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলেছেন, রোজায় শুধু ইফতার ও সেহরিতে খরচ হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা, ৩ কোটি লোক গড়ে ৫ হাজার টাকা করে ১৫ হাজার কোটি টাকা বোনাস পায়। দেশে নিম্নবিত্ত ৫ কোটি পরিবার রয়েছে। যারা গড়ে ১ হাজার টাকা করে খরচ করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
‘এর বাইরে বিত্তশালীরা ১৫ হাজার কোটি টাকা যাকাত দেয়। সব মিলিয়ে ঈদে লেনদেনের আকার হবে কমপক্ষে ৫৫ হাজার কোটি টাকা’, বলেন তিনি।
আজাহারুল হক অবশ্য মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ায় এবার বিক্রি কম বলে দাবি করেন। তার মতে, উৎসব আয়োজনে কেনাকাটা মানুষের শখ, নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। সবাই আগে নিজের প্রয়োজনগুলো পরিপূর্ণ করে। তারপর গিয়ে শখের দিকে নজর দেয় মানুষ। সেটাও একটা কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এখনতো মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। সেটা পূরণ করাই তাই কষ্টকর হয়ে উঠছে।
তবে ঠিক কি কারণে এবারে ব্যবসা-বাণিজ্য কমলো সেটা না জানলেও অর্থনীতির নিম্নগ্রাফ নিয়ে বেশ চিন্তিত আজাহারুল হক আজাদ। ‘এবার বিদেশী পোশাকের দৌরাত্মও তেমন ছিলো না। তারপরও এমন কেনো হলো তা বলতে পারছি না। নির্দিষ্ট কোনো কারণ টের পাচ্ছিনা। তবে সেটা যাই হোক, ব্যবসা কমেছে মানে দেশেরই ক্ষতি।’ সচেতন আরো হতেই হবে বলেও মন্তব্য তার।
আজাহারুল হকের কথার সঙ্গে অবশ্য একমত নন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।
তিনি বলেন, ‘উৎসবের আগে তো সবসময় অর্থনীতির চাকা সচল হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাজনৈতিকভাবে স্থির থাকার কারণে এমনটা হয়েছে। তবে এবার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বৃষ্টি। সরকারের নিরাপত্তা প্রচেষ্টা, বেতন ও বোনাস ভাতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাও সবারে মনে স্বস্তি এনেছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিলো বলেই ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
তবে এবারের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দূর করার কথা বলেন তিনি, বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জ্যামে মানুষের অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যানজটে বসে থেকে মানুষের আর কেনাকাটার মন থাকে না। যানজট নিরসনে উপযোগী পদক্ষেপ নিলে সেটা দেশে ব্যবসার আরো প্রসার ঘটাবে।
আর দেশে বিদেশী পোশাকের দৌরাত্ম বিষয়ে তার মন্তব্য, যদি দেশে সঠিক গুণগত মানসম্পন্ন জিনিস তৈরি হয় তাহলে মানুষ আর বিদেশী পোশাকের দিকে তাকাবে না। এজন্য আমাদের উদ্যোক্তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তারা ভালো কিছু বানালে দেশ আরো লাভবান হবে বলেই মন্তব্য তার।
গত এক সপ্তাহের রেমিটেন্স প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ জানিয়েছে, জুলাই মাসের প্রথম ১০ দিনে অর্থাৎ ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত মোট ৫৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে ৪ থেকে ১০ জুলাই এসেছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সপ্তাহে আসা রেমিটেন্সের রেকর্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গেলো অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৫শ ৩১ কোটি (১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অংক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।