এক.
দূর থেকে বোঝা যায় না, স্টেশন এলাকায় পৌছতেই হাজারো মানুষের দঙ্গল। ঊর্ধ্বশ্বাসে সবাই ছুটছে সামনের দিকে। প্রায় সসব মানুষ রাত জাগা। চোখেমুখে তৃষ্ণা বিতৃষ্ণার এক মিশ্রভাব। শেষ রোজার সাহরির পর ট্রেনকে উদ্দেশ্য করেই স্টেশনে দৌড়। বেশ কদিন আগে থেকে দূরগামী ট্রেনের টিকেট বিক্রি শুরু হলেও শেষ দিনের যাত্রীদেরও বড় একটি অংশ স্টেশনে সারি বেঁধেছে টিকেটে জন্য। সবাই সব অভিমুখের টিকেট পাচ্ছে। ট্রেনে জায়গা থাক আর না থাক, টিকেট নিয়ে ট্রেনে তারা উঠবে। দেশের সড়ক যোগাযোগের অবস্থা বছর খানেক হলো বেহাল হয়ে উঠেছে। যদিও ঈদকে ঘিরে যানজট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বেশ তোড়জোড় ছিল। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বারবার মানুষকে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করেছেন, কোথাও কোনো সংকট নেই। তারপরও গণমানুষের চাপ বলে কথা। সবাই যখন একই নেশায় হামলে পড়ে একই দিকে তখন তো অবধারিত কিছু অব্যবস্থা সামনে এসে পড়ে। খুলনাগামী সুন্দরবন ট্রেন থেকে দেখা যায়, মহাসড়কে স্থির যানবাহনের সুদীর্ঘ সারি। যাত্রীবোঝাই ঈদমুখি বাসগুলোর অলস সময় কাটছে পথে। আর বাসের ভেতর আনন্দমুখি মানুষগুলো চাঞ্চল্য রূপ নিয়েছে অস্থিরতায়। রোজা মুখে এমন নিরাসক্তির চেয়ে কঠিন আর কি হতে পারে?
গত কয়েক বছর হলো মানুষ নতুন করে ট্রেনকে ভালোবাসছে। বলতে হয় ট্রেনের প্রতি হারানো আস্থা একটু একটু করে ফিরতে শুরু করেছে। সময়সূচীর হেরফের একটি সহনীয় মাত্রায় এসেছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলিতে অনেক অভিজাত নতুন কামরার সংযোজন ঘটেছে। মানুষ কিছু বিলম্ব বা অন্যকোনো সমস্যাকে মার্জনা করেই ট্রেনে যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্য। শারীরিক ধকল থেকে থেকে কিছুটা বাঁচতে ট্রেন এক মোক্ষম ব্যবস্থা।
বরাবরের মতোই ট্রেনগুলোতে ঈদ উপলক্ষে জুড়ে দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত কয়েকটি কামরা। এবার ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী ট্রেনকেও অভ্যন্তরীণ রুটের ঈদযাত্রী পরিবহনে সামিল করা হয়েছে।
তারপরও যাত্রীর চাপ কমেনি বরং বেড়েছে। দুই পয়সা বেশি দিয়ে হলেও মানুষ বাসের চেয়ে ট্রেনকেই সুবিধাজনক ভাবছে। এর জন্য অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতেও প্রস্তুত সে। দৃশ্যপটই বলে দিচ্ছে এসব কথা। সেসব কামরায় মানুষ উপরের দিকে তাকিয়ে গায়ে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাপানকুল অভিজাত শ্রেণীর কামরাগুলিতেও দুয়েকজন অনন্যোপায় আর কৌশলী যাত্রী উঠে পড়ে এদিক সেদিক সাধিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে ট্রেনের টিটিসহ দায়িত্বশীলরা তাদের সঙ্গে আচরণ করছেন। টেনে হিঁচড়ে কাউকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, আর কাউকে দু’কামরার মাঝের সংযোগ স্থলে সুন্দর বসতে দেয়া হয়েছে। তবে যারা আকস্মিক ট্রেনে উঠে এই সুযোগ নিতে পারেন, তাদের বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। তারা আচরণ আর অল্পস্বল্প অর্থ দিয়ে ট্রেনের লোককে ম্যানেজ করার দুর্লভ যোগ্যতা রাখেন।
দুই.
ঈদে ঘরমুখো হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের প্রবণতা পাল্টে যাচ্ছে। টিকেট জোগাড় করতে গলদঘর্ম হওয়ার চেয়ে, বহু রকমের যুদ্ধ আর কসরত করে পথ পাড়ি দেয়ার চেয়ে রাজধানীতে বা কর্মস্থলের নগরীতেই ঈদ উদযাপনের মনস্থির করছেন অনেকে। প্রতিবছরই এই প্রবণতা বাড়ছে। যদিও ‘নাড়ির টানে ঘরে ফেরা’র বাস্তবতাই নগরজীবনের এক চিরসত্য বিষয় হয়ে আছে। মানুষ যে হারে পরিজনের মাঝে যেতে চাইছে, নগরজীবনে সে হারে না হলেও ধীর গতিতে হ্রাস পাচ্ছে নাড়ির টান। এখন স্বয়ং ও সাক্ষাত যোগাযোগের বাইরেও বহুমুখী যোগাযোগ সুবিধা আসায় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রিয় স্বজনের মুখ দেখা বা কণ্ঠস্বর শোনার অদম্য তাড়না।
অবশ্য শহর নগরে এই প্রবণতা বাড়তে থাকলেও গ্রামের চিত্র আলাদা। যে গ্রামের জীবন ব্যবস্থাই আমাদের জন সংস্কৃতির উৎসভূমি সেই গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনও শেকড়ের টান অনেক বেশি। তারা যতক্ষণ না নাগরিক জীবনের রসকষহীন বাস্তবতার সঙ্গে মিশছে ততক্ষণ শেকড়মুখি। ট্রেনের জানালায় দেখছি গ্রামাঞ্চলের একেকটি স্টেশনে মানুষের ধীরস্থির অপেক্ষা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর ঝামেলা তাদেরকে শেকড়ের টান থেকে বিমুখ করতে পারে না। স্টেশনে অপেক্ষমাণ মানুষের চেহারা দেখেই মনে হয় ঈদে মতো এই উৎসব পর্বে তাদের শেকড়ে ফেরা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
ঈদ এলে মজার একটি ব্যাপার ঘটে। শেকড় আমাদের টানতে থাকে। আমরা শহরের ক্ষমতা ছাপিয়ে গ্রামের আকর্ষক ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারি। গ্রামের মাঠ, আকাশ, নদী-পুকুর, ঘাস সবই টানতে থাকে। মানুষ দুদিনের জন্য হলেও ছুটে গিয়ে শেকড়ের এসব উপাদানের কাছে বস্তুগত কিছুই পায় না, কিন্তু যা পায় তা হলো উষ্ণ পরশ। যে পরশ তাকে সম্পর্কের সুমিষ্ট সুরভীতে মোহাচ্ছন্ন রাখে সারাটি বছর। অন্তরে গেঁথে রাখে প্রিয়মুখ, প্রিয় সান্নিধ্য, প্রিয় অনুভব। ঘুরেফিরে ধরা দেয় অমোঘ সত্য, দিনশেষে ধর্মই টিকিয়ে রাখে মানুষের যূথবদ্ধ থাকার তাগিদ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)