শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে একের পর এক চাপ দিচ্ছেন পাম্পে। যেন সব শক্তি বিসর্জন দিচ্ছেন রিক্সার চাকায়। এভাবেই একটি করে টায়ারকে মোটাতাজা করে চলছেন রিক্সা চালক সাব্বির হোসেন। উদ্দেশ্য, ঈদ উদযাপন করতে বের হওয়া যাত্রীদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া। আর নির্ধারিত ভাড়ার সাথে বাড়তি আবদার হিসেবে ঈদ বকশিশ পাওয়া। তবে উৎসবের এই দিনে আনন্দ থেকে দূরে রেখেছেন নিজেকে। ঈদের আনন্দ তার কাছে ফিকে।
শুধু সাব্বির রহমান নয়। জীবিকার তাগিদে সোমবার খুব ভোরেই রাজপথে নেমেছেন রিক্সা চালকরা। কর্মে ব্যস্ত হোটেলেকর্মীরাও। পিপাসার্ত পথিকদের পিপাসা মেটাতে প্রস্তুত ছিলেন ডাব বিক্রেতা।এমন নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকের কাছেই একদিনের ঈদ আনন্দ তুচ্ছ।
তারা মনে করেন, সারাবছরই বাঁচতে হয় কষ্ট করে। একদিন আনন্দ করলে কী হবে। সেজন্যই বোধহয় ইট-পাথরের শহরে সবাই যখন স্বজনদের সাথে ঈদানন্দ উদযাপন করছেন, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী এসব মানুষ তখন দুমুঠো অন্ন জোগাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মযজ্ঞে। তাদের ঈদ আনন্দের রং নীল। তাদের জীবন যেন ঈদহীন।
ঈদের দিন (সোমবার) সকালে রাজধানীর শাহাবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলামোটর ও কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেল নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মব্যস্ততার এই ভিন্ন চিত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনের রাস্তায় কথা হয়, রুমান রহমানের সাথে। ময়লা তুলছেন গাড়িতে। বয়স ৯ বা ১০ বছর। বাড়ি ময়মনসিংহে। বাবা নাই। মা আছিয়া রহমান আর ছোট বোন তিন্নীকে নিয়ে থাকে রাজধানীর রমনা পার্কের ধারে। মা-ছেলে ময়লা পরিস্কার আর বোতল সংগ্রহ করে চালায় তিনজনের সংসার।
ঈদের দিন কী করবে? জিজ্ঞেস করতেই তাকিয়ে থাকলো অবাক দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, জামা পরছি আর কাজ করছি। এই বলে আবার ব্যস্ত ময়লা ফেলার কাজে।
বাংলামোটর দেখা গেল পঞ্চাশোর্ধো একজন নারী আপনমনে প্লাস্টিকজাতীয় জিনিসপত্র বাছাই করছেন। রাতভর খুঁজে আনা বিভিন্ন আবর্জনা থেকে বাছাই করে ভাঙ্গারি দোকানে বিক্রয়যোগ্যগুলাকে আলাদা করার কাজে মগ্ন তিনি। ছবি তুলতে সামনে যাওয়ার পর এক পলক তাকালেন। এরপর আর মুখ তুললেন না। কে ছবি তুলছে, কেন তুলছে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার।
কাছে যেয়ে জানতে চাইলাম কেমন আছেন? বললেন, বাবা আছি। কি জন্য জিগাইলা, আমারে চিনো কেমনে। ততক্ষণে বুঝা গেল, কতটা সহজ প্রকৃতির মানুষ এরা।
কখন থেকে এসব বাছাই করছেন জানতে চাইলে বললেন, ‘ভোরে থেইক্কা করতাছি। কাজের কমতি নাই।’ ঈদ আনন্দ যে তাকে ছুঁতে পারেনি তা বুঝার বাকি রইলো না আর।
বাসায় কে কে আছেন, এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে বললেন, বাবা বহ (বস)। অহন (এখন) আমার কেহ নাই। এক পোলা আছিল, এখন বাইচ্ছা আছে না মইরা গেছে জানি না। ছোডকালে হারাই গেছে। আমি অহন কাম করি আর খাই। বাসাবাড়ি নাই। এহানে (পাশের বস্তিতে) থাহি।
বৃদ্ধ এই নারীর একটু দূরে রিক্সার চাকায় হাওয়া দিচ্ছেন সাব্বির। বাড়ি বরিশাল। ১৪ বছর ধরে থাকেন ঢাকায়। দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে বসবাস রাজধানীর কাঁঠালবাগানে।
ঈদ কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে সোজা-সাপটা উত্তর। ‘ভাই, বুঝেন তো। রিক্সা না চালালে ভাত ঝুটে না। আমরা গরীব মানুষ। রোজগার না করলে উপোশ থাকা লাগে। ঈদ আনন্দ আমাদের জন্য নয়। অন্যান্য দিন সকাল ৮ টা বা ৯ টায় বের হই। ঈদ উপলক্ষ্যে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা আগেই রাস্তায় নেমে পড়ছি বাড়তি আয়ের আশায়।
ছবি: জসিম উদ্দিন বাদল