চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ইয়েমেন: যেখানে ক্ষুধার জ্বালায় শিশুরা কাঁদতেও পারে না

এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও হয়তো ইয়েমেনের একটি শিশু বা অনেকগুলো শিশু না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আমাদের দাবি করা উত্তর-আধুনিক সভ্য-সমাজে এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, তাই হয়েছে। হচ্ছে।

গেলো ২১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশ করা প্রতিবেদনটি। সেখানে বলা হয়েছে, গেলো তিন বছরের গৃহযুদ্ধে ৮৫ হাজার শিশু না খেয়ে মারা গেছে যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে। দাতব্য সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী হেলে থরনিং জানান, একটি হাসপাতাল পরিদশর্নে গিয়ে তিনি নিজে দেখেছেন, শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় এতোই দুর্বল যে কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না। এই যুদ্ধে মারা গেছে প্রায় দশ হাজার বেসামরিক মানুষ। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। বহু হতাহতের খবরই পাওয়া যায় না। তিন কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত। ১২ লাখ লোক কলেরায় আক্রান্ত। অনাহারের ঝুঁকিতে আরো ১০ লাখ শিশু।অবরোধের কারণে দুই কোটির বেশি মানুষের এই মুহুর্তে জরুরি খাদ্য সহায়তা লাগবে।জাতিসংঘের সংগৃহীত তথ্য থেকে এই হিসাব নেয়া হয়েছে বলে জানায় সেভ দ্য চিলড্রেন।

ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষে না খেতে পারা হাড়জিরজিরে একটি শিশুর ছবি দেখছিলাম খবরের কাগজে।ছোট্ট শিশুর বুকের হাড়গুলো কেমন ভয়ঙ্করভাবে জেগে আছে। চোখদুটো কোটর থেকে প্রায় বের হয়ে আছে। মুখটি বিকৃত। তাকিয়ে থাকি ছবিটার দিকে। ভাবি হেশিশু! আমি তোমার সময়ে জন্ম নেয়া মানব। তবে কী আমি মানুষ হতে পারিনি?

যুদ্ধনামের কামড়াকামড়িতে শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে কী অনায়াসে। নির্বিকার চোখে দেখছে মানবতাহীন স্নায়ুর দিকে যাত্রা করা ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্বসম্প্রদায়। চিন্তার পরিধি ছেদ করে কখনো কি দেখেছি কোন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছি আমরা?

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হয়ে আঞ্চলিক রাজনীতির নিয়ামক হয়ে উঠা ছাপিয়ে বৈশ্বিক দেন-দরবারে পরিণত হওয়া যুদ্ধে শিশু হত্যাযজ্ঞের অন্তনির্হিত বুঝতে হলে কেন এবং কীভাবে যুদ্ধ শুরু হলো তা জানা অপরিহার্য বলে বোধ করি।

কেন এবং কীভাবে যুদ্ধ শুরু হল:
ইতিহাসের প্রাচীনতম বসতির একটি আর আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশ ইয়েমেন।ইয়েমেনের লড়াইয়ের শুরুটা হয় আরব বসন্ত দিয়ে, যার মাধ্যমে আসলে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। তিন বছরের যুদ্ধে দেশটি এখন প্রায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত।

২০১১ সালে দেশটির দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহকে তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদি অনেকগুলো সংকটের মুখোমুখি হন। সেগুলোর মধ্যে আল কায়েদার হামলা, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করা প্রেসিডেন্ট সালেহর প্রতি অনেক সামরিক কর্মকর্তার আনুগত্য প্রেসিডেন্ট হাদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। এর বাইরে দুর্নীতি, বেকারত্ব আর খাদ্য সংকট তো রয়েছেই।

নয়া প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের যাইডি শিয়া মুসলিম নেতৃত্বের হুতি আন্দোলনের কর্মীরা সাডা প্রদেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ সময় অনেক সুন্নিরাও তাদের সমর্থন যোগায়। এরপর হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা অঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর এডেন থেকে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট হাদি।
হুতি বিদ্রোহী ও দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত ছিল। তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। পেছনে ইরান সমর্থন জোগায় বলে ধারণা করা হয়। এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট হাদি দেশের বাইরে পালিয়ে যান।

এরপর প্রেসিডেন্ট হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে।এই জোটকে সমর্থন করে সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। জোটটির নাম দেয়া হয় সৌদি নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট। তারা ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে। শুরু হয় যুদ্ধ। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গেলো ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহকে হুতি বিদ্রোহীরা হত্যা করে বলে জোরালো সমর্থন পাওয় যায়।

এই যুদ্ধের ‍গিট্টু কোথায়?
ইয়েমেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এখানে কয়েকটি পক্ষ পাওয়া যায়। হুতি-বিদ্রোহী গোষ্ঠী, ইরান, দেশটির সরকারি বাহিনীর দুই গ্রুপ যাদের একটি অংশ সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত, অন্য অংশটি প্রেসিডেন্ট হাদিকে সমর্থন করে। এছাড়াও রয়েছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জোটের সদস্যরা- মিশর, মরক্কো, জর্ডান, সুদান, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সেনেগাল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স।

ইয়েমেন পরিস্থিতি শিয়া-সুন্নি কিংবা ইরান-সৌদি বিরোধের চেয়ে জটিলতর। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা কূটনীতি বুঝতে এই যুদ্ধের মাত্রাগত ভিন্নতার দিকে নজর দিতে হয়। আদৌতে ইয়েমেন সংকট কি আঞ্চলিক সংকট? নাকি বিশ্ব মোড়লেরা এখানে ঘি ঢেলে আঞ্চলিক সমস্যা তৈরি করে ফায়দা লুটছে?

যুক্তরাষ্ট্র কেন এই যুদ্ধে জড়ালো। এর কারণ প্রায় সবারই জানা। ইয়েমেনে গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে সৌদি আরবের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক বজায় রাখা। আর কিছু অস্ত্র-বাণিজ্য হলে তো ষোলো আনাই লাভ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এতই ভালো যে, সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে অভিযোগের যে শক্ত তীর নিক্ষেপ হয়েছে তা নিয়ে নিরব ট্রাম্প প্রশাসন। সিআইএ’ ররিপোর্টকেও ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনা এসেছে। এছাড়াও সৌদির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য। বরাবারের মতো মার্কিন সরকার তাদের স্বার্থ দেখবে এটাই ধরে নেয়া স্বাভাবিক। এজন্যও ইয়েমেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সৌদির সাথে যতই থাকা যায় ততই লাভ। সাপও মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না নীতিই অনুসরণ করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র ।

ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্স এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় হতে বের হতে পারেনি। তাই আপাতত তাদের সামনে ইয়েমেনের বৈধ সরকারকে উৎখাতে পুনরুদ্ধারের ত্রাণকর্তা পরিচয় দেয়াই স্বাভাবিক।

সৌদির সাথে ইরানের সম্পর্কের বৈরিতা আগে থেকেই। এটি নতুন কিছু নয়। ইরান চাইবে আঞ্চলিক শক্তিতে সৌদির চেয়ে পিছিয়ে না থাকতে।এজন্য হুতি বিদ্রোহীদের সমরাস্ত্র থেকে শুরু করে অর্থায়নের দিকটিও তারা দেখবে-স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়। বলা হয়ে থাকে ইরান এবং লেবাননের হিযবুল্লাহ জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার প্যাটার্নের সঙ্গে মিল রয়েছে হিযবুল্লাহ জঙ্গি গোষ্ঠীর। এছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তা হলো ইয়েমেনের সঙ্গে সৌদি আরবের সরাসরি সীমান্ত রয়েছে। সৌদি কখনোই চাইবে না ইয়েমেন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক।গত জুন মাসে রিয়াদকে লক্ষ্য করে হুতি বিদ্রোহীদের ছোড়া মিসাইল ঠেকানোর ঘটনা সৌদিকে আরো সতর্ক অবস্থানে নিয়ে গেছে ইয়েমেন প্রসঙ্গে।

জোটের অন্য সদস্য দেশগুলো সৌদির সঙ্গে রয়েছে নানান দিক বিবেচনায়। ধর্মীয় বিবেচনা তো অবশ্যই রয়েছে। তবে, এই যুদ্ধে হাজার হাজার শিশু না খেয়ে মারা যাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যেও অস্বস্তি রয়েছে।

আঞ্চলিক সংকট নাকি বিশ্ব সংকট:
ইয়েমেনে যা কিছুই ঘটছে, তা যেন আঞ্চলিক দেশগুলোরই ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দেশটি অস্থিরতার মধ্যে থাকলে তা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য হামলার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।

ইয়েমেনের আল কায়েদাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন বলে বলছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কারণ তাদের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে। তবে ইয়েমেনের এই সংকটকে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই হিসেবেও দেখা হচ্ছে। কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি বাব আল-মানডাবের ওপর বসে আছে, যা রেড সি আর গালফ অফ এডেনের সংযোগস্থল। এখান থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে।

দুর্ভিক্ষ কীভাবে সৃষ্টি করা হলো:
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক ছায়া মন্ত্রী ইমিলি থর্নবাড়ি গত ২২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে লিখেছেন ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ-কে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বেশিরভাগ দায় তিনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে দিতে চান সেকথাও স্পষ্ট করে বলেছেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্যিক বন্দর এবং বিমান বন্দরগুলো দখলে রেখেছে হুতি বিদ্রোহীরা। বিশেষ করে হুদাইদা বন্দর দিয়ে সব ধরনের পণ্যের আমদানি রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে বিদ্রোহীরা।

ইয়েমেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের আমাদানির জন্য হুদাইদা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। এতে খাদ্য-সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। না খেয়ে মরছে মানুষ।

এদিকে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট খুব ঠান্ডা মাথায় ও সুকৌশলে ইয়েমেনের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।সেক্ষেত্রে কৃষি জমি-ডেইরি ফার্ম-খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা কিংবা খাবার কেনা-বেচার বাজারগুলো বোমা ফেলে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তের দাবি জানানো হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে ।
বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো যাতে আন্তর্জাতিক জোটের অধীনে চলে আসে সেজন্যই এই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলেযুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য ইমিলি থর্নবাড়ি জানান। এটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে পরিগণিত। এর দায় ইয়েমেন সংকটের জন্য দায়ী সব পক্ষকেই নিতে হবে।

সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক চাপ:
জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিন গ্রিফিথসগত বুধবার ইয়েমেনে পৌঁছান শান্তি আলোচনার জন্য। ইতোমধ্যে সানায় বৈঠক করেছেন হুতি বিদ্রোহী নেতা মোহাম্মদ আলী আল হুথির সাথে। বিভিন্ন বরাতে খবর বেরিয়েছে বিদ্রোহীরা আলোচনায় বসতে আগ্রহী। সোমবার রিয়াদে প্রেসিডেন্ট হাদির সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে জাতিসংঘ বিশেষ দূতের। আগামী ডিসেম্বর মাসে সুইডেনে শান্তি আলোচনা শুরু করতেই এই উদ্যোগ। ২০১৬ সালে একবার শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে, সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ রয়েছে কী-না? এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার পর ইকোনমিক এন্ড পলিসি রিসার্চার মাক ওয়েজব্রুট সম্প্রতি বলেন, আগে হোক পরে হোক এই আত্মঘাতী যুদ্ধ থেকে সরে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ থাকবে। তবে কতজন মারা যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে পিছু হটবে তা জানা নেই।

মূলত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সৌদি আরব নানামুখি চাপের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার শিশু মারা যাওয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। এখানেও সৌদি আরবের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এসব কারণেই ইয়েমেন যুদ্ধের শান্তি আলোচনা দ্রুত এগোতে পারে।
ডেনমার্ক, নরওয়ে ও জার্মানির পর ফিনল্যান্ড সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার ঘোষণা দিয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এ বিষয়ে বৈশ্বিক চাপ ধীরে ধীরে বাড়বে আন্তর্জাতিক জোট এবং হুতি বিদ্রোহীদর ওপর।

আমাদের দায়:
ইয়েমেন যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো শিশুদের উপর যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে তা ব্যবহার করা। নিকট অতীতে এরকমটি আর দেখা যায়নি।
এই যুদ্ধে ৮৫ হাজার শিশু কেন মারা গেলো? সেই দায়বদ্ধতা থেকে নিজেদের নিষ্কৃতি দিতে পারি না। দায় সবারই রয়েছে। নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি এখন বৈশ্বিক। কেউ জাতিক নয়।আর নেটিজেন তো অবশ্যই। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানে শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। একটি শিশু কোন বিচারেই দোষী বা অপরাধী সাব্যস্ত হতে পারে না। সে যেই ধর্মের হোক, যেদেশেরই হোক। শিয়া-সুন্নি কিংবা চামার-চণ্ডালের ঘরে জন্ম নিলেই একটি শিশুর পরিচয় ভিন্ন হয়ে যেতে পারে না। তার পরিচয় সে শিশু।

আপনারা গণতন্ত্র-সরকার-দেশ-জাতি উদ্ধার করেন, সেটি ঠিক আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে অবুঝ, নিরাপরাধ, নির্দোষ শিশুকে না খেতে দিয়ে প্রত্যেকটা মুহূর্ত অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে শুকিয়ে-হাড়জিড়জিড় করে নির্মমভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন তা তো হয় না।

বিশ্বে এখন প্রতিটি দেশের সরকার কীভাবে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায় সে চেষ্টা করছে। শিশুদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে যা যা করণীয় তা করছে। ইউনিসেফসহ আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা বিশ্বের নানা প্রান্তের শিশুদের জন্য নানা ধরনের সাহায্য-সহায়তা করছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে ইয়েমেন যুদ্ধে শিশুদের ওপর এই নারকীয় তান্ডবের তীব্রতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।

এই দায় থেকে মুক্ত নয় জাতিসংঘ, আঞ্চলিক জোট, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থাগুলো। দায় থেকে মুক্ত নয় গণমাধ্যমও। নৈকট্যের প্যারামিটারের দোহাই দিয়ে সে অনুযায়ী সংবাদ ছাপলে গ্রাহক কখনোই যথার্থ চিত্র পাবেন না। ইয়েমেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে স্থানীয় গণমাধ্যমের উদাসীনতা খেয়াল করি।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত অন্তত শিশুদের পক্ষ নিয়ে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে আহবান জানানো। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, শিশু-স্বাস্থ্য বিষয়ে নানা পদক্ষেপের জন্য বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ।আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি এড়িয়ে শিশুদের পক্ষ নিয়ে কথা বললে বাংলাদেশের উচ্চতা বাড়বে বৈ কমবে না।

আমার চাই, খুব দ্রুত ইয়েমেন সংঘাতের সমাপ্তি ঘটুক। শান্তি ফিরে আসুক। আর যেন একটি শিশুও মারা না যায়। মারা না যাক নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ। সে লক্ষ্যে জাতিসংঘ শিগগিরই ব্যবস্থা নিক এবং আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করুক যাতে দেশেটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিরাজমান হয়। আর সেই সাথে তদন্ত করে দেখা হোক আসলেই ইয়েমেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা? হলে এর জন্য দায়ী সব পক্ষকেই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তা নাহলে মানবতার কথা বলে বেশি দূর এগুতে পারা যাবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)