পাকিস্তান আমলে কথিত ২২ ধনী পরিবারের একটি ছিল ইস্পাহানি। সেই পরিবারেরই একটি অংশ বাংলাদেশের বিখ্যাত ইস্পাহানি গ্রুপ। চা-পাতা থেকে শুরু করে পাট, টেক্সটাইল, মিডিয়া এবং প্যাকেটজাত খাবারসহ নানা ব্যবসাক্ষেত্রে ইস্পাহানি গ্রুপ পরিচিত এক নাম।
একাত্তরের আগে পরে ইস্পাহানিদের নিয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই। বরং আওয়ামী লীগকে সহায়তা করে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। তাই পাকিস্তান আমলের ধনী পরিবার হিসেবে বাঙালির পছন্দের তালিকায় না থাকলেও পরে বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে উঠে ইস্পাহানি পরিবার। এর পেছনে তাদের নির্ভেজাল বাংলাদেশপ্রীতি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, ইস্পাহানি গ্রুপের জন্ম কিন্তু পাকিস্তানে নয়। ইস্পাহানি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হাজী মোহাম্মদ হাশেম ইস্পাহানি ১৮২০ সালে পারস্যের ইস্পাহান শহর থেকে ভারতের মুম্বাইয়ে এসে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ইস্পাহানিদের ব্যবসা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক এ. এইচ. এম মোয়াজ্জেম হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি যতদূর জানি উনাদের পরিবার ইস্পাহান থেকে এসেছেন। তারা ভারতে ব্যবসা করেছেন, মিয়ানমারেও ব্যবসা করেছেন। ৪৭ সালে দেশভাগের পরে উনারা ২ ভাগে ভাগ হন। একভাগ পাকিস্তানে চলে যান, অন্যভাগ পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের ব্যবসা প্রথম দিকে চা কেন্দ্রিক ছিল। সেটাই তারা শুরু করেন বাংলাদেশে। তাদের জুট ব্যবসা ছিল, টেক্সটাইল ব্যবসা ছিল।
এরপর একসময় তারা বাংলাদেশ থেকে চলেও যান। পরিবারের ওই অংশটি লন্ডনে থাকার সময় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাদের এখানে থাকা সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দিয়ে দেন। এবং এখানেই তাদের ব্যবসা করতে বলেন। তারপর থেকে তারা এখানে ব্যবসা করতেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিষয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই গ্রুপের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। সবগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। বামদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল।
তবে বাংলাদেশে শুধু থাকাই নয়, বাংলাদেশকে ধারণ করতেন এই পরিবারের লোকজন, এমনটাই মনে করেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, সেজন্যই ইস্পাহানি পরিবারটির একটি অংশ এই অঞ্চলে থেকে গেছেন। তাদের পাকিস্তানে কিছু সম্পত্তি আছে। কিন্তু পাকিস্তানেরটা সেখানে ইনকর্পোরেটেড আর বাংলাদেশেরটা বাংলাদেশে ইনকর্পোরেটেড। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ইনকের্পোরেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। এম এ ইস্পাহানির বংশের লোকেরা এখন বাংলাদেশে থাকেন।
একই কথা বলছিলেন ৭১ টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও ইস্পাহানি গ্রুপের একটি অসাধারণ সম্পর্ক ছিল। একসময় তাদের পরিবারের অন্য অংশ পাকিস্তানে চলে গেলেও অন্যরা বাংলাদেশেই থেকে যায় এবং এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যায়। এই যে এত বছর এই গ্রুপ বাংলাদেশে ব্যবসা বাণিজ্য করেছে তাদের বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ নেই। কোন ঋণ খেলাপির অভিযোগ নেই। কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই।
বাংলাদেশের সঙ্গে ইস্পাহানি গ্রুপের সম্পর্কটা আত্মিক, এমনটাই মনে করেন ইশতিয়াক রেজা। তিনি বলেন, এই সম্পর্কের জন্যই তারা এদেশ ছেড়ে যাননি। এখানেই থেকে গেছেন। এবং তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও এই গ্রুপের একটি গভীর সম্পর্ক ছিল।
সেই ইস্পাহানি গ্রুপের চেয়ারপার্সন মির্জা আলী বেহরুজ ইস্পাহানি সোমবার ভােরে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা গেছেন।
তিনি ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি বিষয়ক জাতীয় দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের উদ্যোক্তা পরিচালক এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের অন্যতম একজন সদস্য। ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজেরও চেয়ারম্যান ছিলেন মির্জা আলী বেহরুজ।
দীর্ঘ বছর ধরে বাংলাদেশে ইস্পাহানি পরিবার সামাজিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে এ পর্যন্ত নয়টি স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, মির্জা আহমেদ স্মৃতি বিদ্যালয়, সিজেএম হাই স্কুল, ওয়াইসিয়া দারুস্ সুন্না দাখিল মাদ্রাসা, মির্জা আহমেদ হাই স্কুল, ভিক্টরী হাই স্কুল, কুমিল্লা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, ইস্পাহানি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ (ঢাকা) ও সিদ্বেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
বাংলাদেশে ইস্পাহানি পরিবারের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল।
ইস্পাহানি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হাজী মোহাম্মদ হাশেম ইস্পাহানি। তিনি ১৮২০ সালে পারস্যের ইস্পাহান শহর থেকে ভারতে এসে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ইস্পাহানিদের ব্যবসার পরিধি ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ১৮৮৮ সালে মির্জা মেহেদী ইস্পাহানি ঢাকায় তাদের একটি শাখা অফিস স্থাপন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে ইস্পাহানি পরিবার তাদের কর্পোরেট হেড অফিস চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে। বর্তমানে কোম্পানিটি বাংলাদেশে ব্যক্তিখাতে অন্যতম বৃহৎ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান।