ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। শুধু আক্ষরিক অর্থেই না, মানব ইতিহাসে নানা সমাজে, দেশে সামাজিক শান্তি স্থাপন করে শাস্ত্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলাম অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। ভারতীয় উপমহাদেশেও নানা ধর্মের জাত-পাতের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পথ খোলে দিয়েছিল ইসলাম। বিশ্বের নানা প্রান্তে অন্যান্য ধর্মের মানুষের স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্মগ্রহণ অব্যাহত আছে।
প্রতিবেশী ভারতে এখনো দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং বৈষম্য থেকে নিজেদের বাঁচাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে চলেছেন। ২০১৬ সালের মার্চ ১৬ তারিখে দি টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট (http://timesofindia.indiatimes.com/…/articlesh…/51419977.cms) থেকে জানা যায়, পাঁচ বছরে গুজরাট প্রাদেশিক সরকার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছ থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য ১ হাজার ৮শ ৩৮টি দরখাস্ত গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ১ হাজার ৭শ ৩৫টি, অর্থাৎ ৯৪.৪ শতাংশ দরখাস্ত জমা দিয়েছে ‘হিন্দু’ ধর্মের লোকজন। জন্মসূত্রে এরা ‘হিন্দু’ হলেও নানা সামাজিক, রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এরা আর নিজের ধর্মে থাকতে চাচ্ছে না। বলাবাহুল্য যে, ধর্মান্তরিত হতে ইচ্ছুক এই মানুষগুলো দলিত সম্প্রদায়ের এবং তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে চেয়ে আবেদন করেছেন। বেশিরভাগ আবেদনই জমা পড়েছে, সুরাট, রাজকোট, পরবান্দার, আহমেদাবাদ, জামনগর এবং জুনাগড় থেকে।
তবে গুজরাটের দলিত সংগঠন এর সভাপতি জয়ন্ত মানকান্দিয়া টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, সরকার যদি বলে থাকে যে ধর্মান্তরিত হতে শুধুমাত্র ১ হাজার ৭শ ৩৫টি দরখাস্ত জমা পড়েছে, তাহলে এটা পরিষ্কার যে সরকার সব দরখাস্ত তাদের রেকর্ডে নেয়নি।
১৯৫০ সালে সাংবিধানিকভাবে ভারতে জাত-পাতের সামাজিক ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবে এখনো ভারতে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত এবং উচ্চজাত), ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা), বৈশ্য (ব্যবসায়ী) এবং শূদ্র (খেটে-খাওয়া মানুষ) ইত্যাদি জাতে মানুষকে ভাগ করে বৈষম্য করা হয়। জাত-পাতের সমস্যা এতটাই প্রকট যে, এক জাতের হিন্দু আরেক জাতের কাউকে বিয়ে করলে বা তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক হলে খুন পর্যন্ত করা হয় বাংলাদেশের যুগান্তর পত্রিকায় ২০১৭ সালের ২৪ মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখতে পাই- ‘ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের দুটি গ্রামে মন্দিরে প্রবেশ করার অনুমতি না মেলায় ক্ষুব্ধ ২৫০টি দলিত পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যাইহোক, অন্য কোনো ধর্মকে মূল্যায়ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম আমাকে সে শিক্ষা দেয়নি কখনো। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ আছে আমাদের ধর্মে। কার্ল মার্কস আবার সব ধর্মকেই অপিয়াম বলে বর্ণনা করে ধর্মের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে সাবধান করে গেছেন। তবে আমার ধর্মের বিরুদ্ধে বা আমার ধর্ম নিয়ে যদি কোনো অপরাজনীতি হয়, কিংবা কেউ যদি ইসলামের নামে সন্ত্রাস করে তাহলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অধিকার আমার আছে।
ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে চলছে সিস্টেম্যাটিক প্রোপাগান্ডা। ইসলাম, মুসলিম, টুপি, দাঁড়ি, হিজাব ইত্যাদি শব্দ বা ধারণা প্রতিদিন নেতিবচাক নানা বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে বিবিসি, সিএনএন, এপি, এএফপি, রয়টার্সসহ বিশ্বের নানা শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে। ফলে ‘ইসলাম’ ভয়ঙ্কর, মুসলমানদের উপর যা খুশি করা যায়, এরা জঙ্গি, ইত্যাদি নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
ইরাকে, আফগানিস্তানে হামলা করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিন সেখানে মানুষ মরে শত শত। শিশু মারা যায়, এতিম হয়, পঙ্গু হয়। কিন্তু দোষ হয় শুধু মুসলমানদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, ন্যাটো বাহিনীকে কেউ জঙ্গিবাদী বলে দাবি করবেনা, কেউ বলবেনা এরাই বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা এবং পালনকারী। এমনটা কেউ দাবি করলেও সেটি প্রচার পাবেনা। পশ্চিমা শক্তিই যে আইএস তৈরি করে নিজেদের স্বার্থে এই কনসেপ্ট ব্যবহার করছে সেটি বিশ্বের ক’জন মানুষ জানে বা মানে? এর আগে ব্যবহার করেছে আল-কায়েদা কনসেপ্ট।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সংবাদমাধ্যম ও বিজেপির মত রাজনৈতিক দলগুলোও পিছিয়ে নেই মুসলমানবিদ্বেষী নানা অপপ্রচারে। ভারতে যে মাওবাদী সন্ত্রাসীদের হামলায় শত শত মানুষ, পুলিশ, সেনাসদস্য নিহত হয় তা তেমন কাভারেজ পায়না। কিন্তু যদি কোনো ঘটনায় মুসলমান কোনো নাম জড়িত থাকে তাহলে দেখা যায় সাংবাদিকতার বাহার। ভারতের উত্তরপ্রদেশে বেশ কয়েকদিন ধরে উচ্চ বর্ণের হিন্দু আর নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। আমাদের দেশের কয়টা মিডিয়া এই বড় ঘটনার কাভারেজ দিয়েছে? কাভারেজ দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশে তো বাঁধা নাই। ভারতে একজন মুসলমান কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ যে পরিমাণ কাভারেজ পায়, হিন্দু জঙ্গিজোট শিবসেনা, আরএসএস, বিজেপি কিংবা বজরং পার্টির সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত এবং নিগৃহীত মুসলমানদের সংকট কতখানি সংবাদমাধ্যমে আসে? গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে, ফ্রিজে মাংস রাখার অপরাধে সেখানে মুসলমানদের পিটিয়ে মেরে ফেলছে জঙ্গি হিন্দুরা। এরপরেও সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদের বদনাম নিতে হচ্ছে শুধু মুসলমানদেরই। কারণ সেই
সিস্টেম্যাটিক ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডা। মুসলমান কর্তৃক অপরাধের খবরগুলো নিয়মিত আসে, কিন্তু অন্যদেরটা আসেনা। বলা হয় ইসলামি জঙ্গি, মুসলিম জঙ্গি ইত্যাদি। কিন্তু শিবসেনার হামলায় মুসলমান মারা গেলে বলা হয়না যে, হিন্দু জঙ্গি। এখানেই মূল রহস্য লুকায়িত। মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের হাতে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমান নিধনের নিউজে কেউ লিখেনা, ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘বৌদ্ধ জঙ্গি’। কেউ লিখুক আমরা চাইনা। কারণ পুরো সম্প্রদায় কিংবা ধর্ম তো এই হত্যাকাণ্ড করতে বলেনি। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে আমরা সেই অমোঘ বাণী স্মরণ করতে পারি-`জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
শুধু কি সংবাদ? চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে, বিজ্ঞাপনে মুসলমানদের নেতিবাচক চিত্রায়নই চলছে। ভারতের কমার্শিয়াল সিনেমাগুলোতে দেখা যায়, মাদকব্যবসায়ী, গুন্ডা, সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগই মুসলমান। ‘ইসলামিক’ জঙ্গিবাদের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র হলে তো কথাই নেই। সাধারণ সিনেমায় অযথা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে মুসলমান ভিলেন, মুসলমান গুন্ডা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভিলেন যদি ‘হিন্দু’ ধর্মের অনুসারীও হয়, তার গুন্ডাবাহিনীর করিৎকর্মা সন্ত্রাসীগুলো অধিকাংশই মুসলমান হয়। এদের মাথায় স্কার্ফ থাকে, চোখে থাকে সুরমা, এরা খুন করার আগে নামাজ পড়ে, চাঁদাবাজি বা মার্ডার করার আগে ‘আসসালামুআলাইকুম, বলে। ‘জিহাদ’ শব্দটাকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, কোনো শিক্ষিত মুসলমান ভুলেও নিজেকে ‘জিহাদি’ বলে দাবি করবেনা। জিহাদি শব্দের প্রচলিত অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে।
অথচ ইসলাম ধর্মে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে জিহাদ বলা হয়েছে। যে কোনো জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী হবে সেই জিহাদি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করলে এদেশের মানুষ জিহাদ করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসরদের দ্বারা হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জবাব দিতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। জিহাদ করে দেশ স্বাধীন করেছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। কিন্তু কেউ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জিহাদি’ বলেন তাহলে সাধারণ বিবেচনায় কেমন লাগবে আপনাদের? অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস বা সামর্থ্য না থাকলে মনে মনে ঘৃণা করতে বলা হয়েছে ইসলামে। ইসলামে আরও বলা হয়েছে, সুদ, দুর্নীতি, হিংসাসহ ষড়রিপুর বিরুদ্ধে লড়াই করা হল সবচেয়ে বড় জিহাদ। অথচ, জিহাদ শব্দটাকে মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের সাথে ক্রমাগত জুড়ে দিয়ে পুরো ধারণাকেই বিগড়ে দেয়া হয়েছে।
ভারতীয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ইতিহাসভিত্তিক সিরিয়াল বানানো হচ্ছে। ইদানিং এসব ইতিহাস ভিত্তিক সিরিয়ালে মুসলমান শাসকরা কত ভয়ঙ্কর অত্যাচারী ছিলেন তার উপস্থাপন চলছে। টিভি সিরিয়াল নির্মাতারা এতই পারদর্শী যে অভিনেতা অভিনেত্রীর চেহারা, পোশাক, মেকআপ দেখেই বোঝা যা কে মুসলিম আর কে হিন্দু, কে মন্দ আর কে ভালো। সিরিয়ালে যেভাবে ইতিহাস বিকৃতি চলছে তাতে ইসলামের অতীত ও বর্তমানের বাস্তবতায় উদ্বিগ্ন হতে হয়। ভারতের জাত-পাতের সমস্যা, ভয়াবহ অর্থনৈতিক দারিদ্র, বৈষম্য ইত্যাদিকে ছাপিয়ে মুসলমানদেরকে একটি কমন ইনেমি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। টেলিভিশন সিরিয়ালগুলোতে ইতিহাসের সব মুসলিম শাসককে অত্যাচারি, ধর্ষক, নিপীড়ক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ইতিহাস বিকৃত করে স্কুলে-কলেজে পড়ানো হচ্ছে। ইসলাম, মুসলমানদের বিষয়ে শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বে সিস্টেমেটিক অপপ্রচার চলছে। এইজন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেড়াতে গেলে বিমানবন্দরে, ভিসা প্রক্রিয়ায়, ঘরভাড়া, চাকরি, পড়াশুনা সর্বক্ষেত্রে মুসলমানরা সমস্যার মোকাবেলা করছে। ভারতে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে এক করে দেখার প্রবণতা আছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মুম্বাই শহরে হোটেল ভাড়া না পাওয়ার স্মৃতি নিশ্চয় এখনই হারিয়ে যায়নি আপনাদের। ভারতে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশীদের পাকিস্তানি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে একই ডেস্কে রিপোর্ট করতে হয়। হলিউডি সিনেমায়ও অত্যন্ত পারদর্শিতার সাথে ইসলাম আর মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়। ইরাক, আফগানিস্তান নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো দেখলেই আমার কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। দেখানো হয়, ইরাকে কিংবা আফগানিস্তানে মানুষ খুব কষ্টে আছে, তাদের উদ্ধার করতে গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদল কিংবা কোনো কমান্ডো। আফগানিস্তানের তালিবান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি সে কথা কিন্তু কোথাও বলা হয়না।
বিশ্বজুড়ে ইসলাম-বিরোধী প্রচারের ফলে এবং নিজের শিকড়-বিচ্ছিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের মুসলমানদের একাংশের আত্মবিশ্বাস এমনি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে যে এরা নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করতে গিয়ে ‘ইসলাম’ ধর্মকে হরহামেশা কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। এদেরকে সমাজে বলা হচ্ছে, ‘চরমপন্থী প্রগতিশীল’। ‘ইসলাম’, ‘আল্লাহ’ ইত্যাদি শব্দ শুনলেই এরা তেড়ে আসে। এদের সংখ্যা খুব বেশী না। কিন্তু এরা প্রভাবশালী এবং ঝামেলা বাঁধাতে উস্তাদ। এদের বিপরীতে আছে কট্টর ‘ইসলামপন্থীরা’। এই ‘ইসলামপন্থীরা’ নিজেদের এতই কামেল মনে করেন যে, সাধারণ স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের এরা বিপথগামী মনে করেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সব মজা তারা নেন, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন না, শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে চান। বিজ্ঞানহীনতা যে এই মোল্লা শ্রেণিকে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মাঝে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে সেটি মনে হয় আমাদের ‘হুজর’গণ বুঝতে পারছেন না। তবে স্বস্তির বিষয় হল, এই ‘চরমপন্থী প্রগতিশীল’ আর কট্টর ‘ইসলামপন্থী’দের সংখ্যা সমাজে খুব বেশী না। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক বিশেষ শ্রেণির মানুষেরাই সমাজে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করেন এবং কখনো কখনো সফল হন।
সর্বশেষ গ্রিক দেবি থেমিসকে বাংলাদেশী শাড়ি পড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে ভাস্কর্য/মূর্তি স্থাপন এবং অপসারণ নিয়ে যা হল, তাতে আমার কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর সংকট আরো বেশী। দেশের অধিকাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক নানা উপাদানকে অস্বীকার করে কী এক অজানা উদ্দেশ্যে এরা সাংবাদিকতা করছে, সেটি সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অসাধারণ ইনিংস খেলার পর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মাঠে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করেছিলেন। কী কারণে, আমার দেশের মিডিয়া সেই ছবিটা বেমালুম গায়েব করে দেয়। কোথাও পরে আর এ ছবি দেখা যায়নি। কেন এমন হবে? মাহমুদুল্লাহর সিজদার ছবি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ টেলিভিশনে দেখেছে। রোজার মাসে ইসলাম ধর্মের অনুসারী একজন বাঙালি খেলোয়াড় সেঞ্চুরির পরে সিজদা দিয়েছেন এমন একটি ছবি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে প্রচার পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এদেশের শিক্ষিত মুসলমান সমাজের অনেকের ভেতরে যে সংকট সারাজীবনের জন্য ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তার প্রমাণ রাখতে গিয়ে আমাদের মিডিয়াতে এটি প্রচার পেল না। বাঙ্গালি শিক্ষিত মুসলমানের অনেক সংকট। হাঁচি আসলে আলহামদুলিল্লাহ বলবে, না কি ‘এক্সকিউজ মি’ বলবে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনা। মুখের দাঁড়ি একটু বড় হলেই বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানের মনে সংকট তৈরি হয়। বাইরের কেউ দেখে ফেলে কি না, ভয় লাগে। মা-বাবার টেনশন বেড়ে যায়। সালাম দিতে বা নিতেও এই শ্রেণির মানুষ অস্বস্তিবোধ করেন। শহুরে ‘শিক্ষিত’ মুসলমান সমাজে আজকাল দেখা হলে ‘আসসালামুআলাইকুম’ বলে বাতচিত শুরুর চর্চা প্রায় বিলুপ্তির পথে। কেউ কেউ আছেন যারা সালাম দেয়াকে পিছিয়ে থাকা মনে করা হয়। এমনও দেখেছি, সালাম যারা দেয়, তাদেরকে ‘শিবির’, ‘জামাত’ বলে বর্ণনা করা হয়!
কিন্তু টুপি-দাঁড়ি ছাড়া যারা বড় হয় তারাও যে সমাজের জন্য কলঙ্ক আনতে পারে তার প্রমাণ তো আমরা গুলশানের সন্ত্রাসী হামলায় অবলোকন করেছি। বড় বড় পরিবার থেকে এই জঙ্গিগুলো বের হয়েছিল। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করা, হলিউডি স্টাইলে বড় হওয়া, চলাফেরা করা জঙ্গিগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের বাঙালি মুসলমানের ভেতরের সংকট কেবল মাদ্রাসা-কেন্দ্রিক নয়। জঙ্গিবাদের সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু হলেই এদেশের মাদ্রাসা কমিউনিটিকে গালিগালাজ করেন যারা, তাদের জন্য গুলশানের হামলা হতে পারে আত্ম-উপলব্ধির একটা সুযোগ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েও ছেলে-মেয়ে জঙ্গি হচ্ছে। অথচ অতি সরলীকরণ করে বলা হচ্ছে যে, মাদ্রাসায় জঙ্গি উৎপাদন করা হচ্ছে। জেনারেল লাইনে বা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে-মেয়েরাই কিন্তু এদেশে দুর্নীতি করছে বেশী, যেখানে মাদ্রাসা কমিউনিটির দুর্নীতিতে অবদান নাই বললেই চলে। ঢাকার কিছু অপরিণামদর্শী বুদ্ধিজীবী যখন কিছু হলেই পুরো মুসলমান সমাজকে, ইসলামকে গালিগালাজ করেন তখন লাভবান হয় কারা? একমাত্র লাভবান হয় স্বাধীনতা-বিরোধী জামাত আর হিন্দু সমাজের ভেতরে কাজ করা একটি কট্টরপন্থী অংশ। এতে করে হেফাজতের মত ধর্ম-ভিত্তিক অরাজনৈতিক শক্তির কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায় জামাত। যে দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান, সে দেশে যে যেকোনো কট্টরপন্থা বিপদজনক, এই সহজ কথা যারা বুঝেনা তারা কীভাবে নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করেন বুঝিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে থেমিস এবং কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস এর স্বীকৃতি ইস্যুতে যেভাবে এদেশের ‘প্রগতিশীল’ অংশ গালিগালাজ করেছে তাতে তাদের অপরিণামদর্শীতা প্রতিভাত হয়।
আত্মবিশ্বাস আর আত্ম-পরিচয়ের সংকটে ভোগা এসব মুসলমানেরা নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস নিয়ে নিজেদের গালিগালাজ করে সমাজে প্রগতিশীল পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। এতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। গন্তব্যহীন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে শিকড়বিহীন সব গাছ, একটু ঝড়েই উপড়ে যাচ্ছে এরা। এখন দরকার সংকটসমূহের গভীরে যাওয়ার। পৃথিবীর সব মুসলমানদের এক করে দেখার একটি প্রবণতা এবং চর্চা শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে।
ইসলাম এ অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে আছে। তাতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, গবেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক তার ‘বাঙালি সমাজে ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিকেরা দেখিয়েছেন যে, অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের দ্বারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-নোয়াখালি অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল। সে থেকে যদি আমরা বাংলায় ইসলামের সূচনা ধরি তাহলে-অন্তত বারো’শ বছর ধরে বাঙালি-সমাজের কোনো না কোনো অংশে, যেভাবেই হোক, একটি সক্রিয় মতাদর্শরূপে ইসলাম অস্তিত্বশীল আছে’।
আবুল কাশেম ফজলুল হক এই প্রবন্ধে আরও লিখেছেন, ‘বাঙালি মুসলমানের উৎপত্তির ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এই মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা পূর্ব থেকেই এদেশেরই অধিবাসী ছিলেন, এবং তারা প্রধানত আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রয়োজনে বৌদ্ধ, হিন্দু ও অপরাপর ধর্মমত ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আরব-ইরান থেকে স্বল্প সংখ্যক ইসলাম প্রচারক সুফি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশী এসেছিলেন আরবীয়-ইরানীয় সুফিদের শিষ্য উত্তর-ভারতীয় সুফি। উত্তর-ভারতই ছিল তখন ভারতব্যাপী ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র। সুফিদের মাধ্যমে আরবীয় ও ইরানীয় রক্তের সামান্য মিশ্রণ মুসলিম বাঙালিদের মধ্যে ঘটেছে। তবে তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তা ধরা পড়ে না। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে মুসলমান বাঙালি আর হিন্দু বাঙালি অভিন্ন। বাঙলার ভূখণ্ডে শেষ পর্যন্ত আশরাফরাও আতরাফদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
মুহম্মদ এনামুল হক ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’ এবং A History of Sufism in Bengal’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, বাংলার সুফিরা তাদের মতবাদের জন্য উত্তর ভারতীয় সুফিদের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন।…কোনো কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রচারিত হয় তখন তাতে নানা পরিবর্তন ঘটে থাকে। ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এজন্য ইসলাম বাংলায় যে রূপ পরিগ্রহ করেছে, মুহম্মদ এনামুল হক যথার্থভাবেই তাকে বলেছেন,’বঙ্গের লৌকিক ইসলাম’।
বঙ্গের এই ‘লৌকিক ইসলাম’ যত দ্রুত আমাদের কট্টরপন্থী প্রগতিশীল আর কট্টর ইসলামপন্থী বাঙালি মুসলমানের মধ্যে পরিষ্কার হবে, বোধগম্য হবে তত আমাদের বাঙালি মুসলমান সমাজের তথা অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মঙ্গল। তবে এই বড় কাজটি করতে গেলে দেশের রাজনীতিবিদ, লেখক-সাহিত্যিকদের চেতনাগত ও কর্মকাণ্ডের দিক থেকে পুরোপুরি সৎ হতে হবে। কিন্তু এরা কি এতটা সৎ?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)