ঢালিউডের এ সময়কার ব্যস্ততম নায়ক বাপ্পী চৌধুরী। ‘জাজ মাল্টিমিডিয়া’র মাধ্যমে ‘ভালোবাসার রঙ’ সিনেমা দিয়ে ২০১২ সালে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। এরপর থেকে অভিনয় করেছেন প্রায় দুই ডজন সিনেমায়। বর্তমানে ‘সিক্রেট এজেন্ট’, ‘ঢাকা ২০৪০’ সহ একগুচ্ছ সিনেমা বাপ্পীর হাতে। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’, ‘জেঞ্জার জোন’ সিনেমাগুলো। ক্যারিয়ার, চলচ্চিত্রের এদিক-সেদিক নিয়ে বাপ্পী আলাপ করলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে…
দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’-এর শুটিং শেষ অনেক আগে। মুক্তি পাচ্ছে না কেন?
অফিশিয়ালি কিছু সমস্যা ছাড়াও আমার মনে হয়, ঢাকার রাস্তায় যেমন মানুষ জ্যামে পড়ে; ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’ সিনেমাটিও একটু জ্যামে পড়েছিল। জ্যাম কেটে যাচ্ছে, এবার ছাড়ার পালা। আর পুরো সিনেমাটি অনেক ভালো হয়েছে। প্রোডাকশন হাউজ (বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া) থেকে অনেক প্রশংসা পেয়েছি। তারা সিনেমাটি নিয়ে আশাবাদী।
রিয়াজ-শাবনূরের ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ যেমন সাফল্য পেয়েছিল। কি মনে হয় ওই সাফল্য ছুঁতে বা উতরে যেতে পারবেন? বা এসব ভেবে শুটিংয়ের সময় কোনো চাপ অনুভব করেছেন?
চাপ অবশ্যই ছিল। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ এতটাই সফল ছিল যে, নামটাই ব্র্যান্ড! এরসঙ্গে কাস্টিংও। সেক্ষেত্রে বাড়তি প্রেসার ছিল। কারণ, আগেরবার দর্শক যেখানে রিয়াজ ভাইকে দেখেছে, এবার সেখানে আমাকে দেখবে। আগের চেয়ে এবার গল্পটা আলাদা। আর দেবাশীষ দাদা, আমি, অপু বিশ্বাস, সাদেক বাচ্চু সাহেব সবকিছু মিলিয়ে আমার আশা, আগের চেয়ে বেটার কিছু হবে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’-এ।
‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’ শুটিংয়ের সময় নাকি অপু বিশ্বাসের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছেন। এমন গুঞ্জন উঠেছিলো?
আমার প্রত্যেক সিনেমাতেই কিছু না কিছু গুঞ্জন ক্রিয়েট হয়। এবারও বিষয়টিকে আমি একেবারেই গুঞ্জন হিসেবে দেখছি। এ ব্যাপারে এরবেশি কিছু বলতে পারবো না।
‘সিক্রেট এজেন্ট’ সিনেমাটি সম্পর্কে বলুন। কেউ কেউ বলছেন বাপ্পীর নায়িকা চুজিংয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত?
পরিচালক যাকেই পছন্দ করেছেন তার সঙ্গেই কাজ করছি। পরিচালকের ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে কাজ করতে বেশি পছন্দ করি। গল্পটা আমাকে ঘিরেই। আর আমি কখনই নায়িকা নির্ভর সিনেমায় কাজ করি না। যা কাজ করেছি সব সিনেমাই নায়ক নির্ভর। এ সিনেমার পরিচালক সাফি উদ্দিন সাফি। তার সঙ্গে আমার লাক ভালো। এর আগে ‘প্রেম প্রেম পাগলামি’, ‘হানিমুন’, ‘মিসড কল’ সিনেমাগুলোতে তার নির্দেশনায় কাজ করেছি। তার সঙ্গে অনেকদিন পর কাজ করছি। বড় আয়োজনে শুটিং করছি। এখানে দর্শক আমাকে শুরুতে ভিলেন হিসেবে দেখতে পাবে। তারপর কী হবে আর নাই বা বলি…!
ইফতেখার চৌধুরীর পরিচালনায় ‘যুদ্ধ’ নামে নতুন একটি ছবি করতে যাচ্ছেন। হৃতিক-টাইগার শ্রফ ‘ওয়ার’ নামে একটি সিনেমা করলেন। ‘যুদ্ধ’ কী এমন কিছু হতে যাচ্ছে?
‘যুদ্ধ’ সিনেমা হবে আমাদের দেশকে ঘিরে। সেপ্টেম্বর মাসে শুটিং শুরুর ইচ্ছে আছে। এটা পুরোপুরি লোড অ্যাকশন সিনেমা হবে। এ সিনেমার জন্য নিজেকে নতুনভাবে প্রস্তুত করতে হবে। তাই জুন নাগাদ দেশের বাইরে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। তার আগে ‘সিক্রেট এজেন্ট’ এবং রুম্মান রুনির নাম চূড়ান্ত না হওয়া নতুন একটি সিনেমার কাজ শুরু করবো। যেটা হবে পিওর ট্রাজেডি গল্পের সিনেমা। তারপর যুদ্ধে নামবো।
‘ঢাকা ২০৪০’ নাকি বাজেট সংকটে আটকে আছে?
না, এমনটা নয়। দ্বিতীয় লটের শুটিং আমি লক করতে পারিনি। প্রথম লটের পর আমার স্কেজ্যুয়াল বেশি টাইট হয়ে যায়। দ্বিতীয় লটে কাজ করতে হবে টানা ২০ দিন। তখন ২০ দিন টানা সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। এপ্রিল-মে মাসের দিকে হয়তো বাকি কাজ শেষ করতে পারবো।
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বেশ কিছুদিন আপনার কাজে গ্যাপ ছিল। কেন?
এটা আমি ইচ্ছে করেই করেছিলাম। পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিছুটা অভিমানও ছিল। সবকিছু নিয়েই অভিমানটা ছিল। অভিমানটা আমার ব্যক্তিগত, শেয়ার করার মতো নয়।
শুনেছি এই সময়ে সিনেমার বাইরে আপনি বিকল্প পেশা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেছেন?
আমার রক্তে মিশে আছে ব্যবসা। আমাদের মূল ব্যবসা নারায়ণঞ্জে। আমার বাবা-ভাই এ ব্যবসায় জড়িত। কিন্তু এতোদিন কাউকে জানাইনি। অভিনয়টা আমার প্যাশন। সিনেমায় কাজ করে অনেক উপার্জন করতে হবে এমনটা ভাবিনি। তার মানে এই নয় যে, আমি এখানে ভবিষ্যৎ দেখছি না।
আপনি মুখে মাস্ক পরে মুক্তি পাওয়া সব সিনেমাই নাকি হলে গিয়ে দেখেন। এই চর্চাটা কবে থেকে শুরু?
যখন আমি সিনেমায় আসি তখন থেকেই প্রতিটি নতুন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখি, সেই ‘ভালোবাসার রঙ’ থেকে। ওই সময় থেকে থেকে আজ পর্যন্ত এ দেশের মুক্তিপ্রাপ্ত এমন কোনো সিনেমা নেই যে আমি দেখিনি। শুটিং না থাকলে আগে শুক্রবার নারায়ণগঞ্জ চলে যেতাম। সেখানে আমাদের স্থানীয় সিনেমা হলেই দেখতাম।
প্রযোজক-পরিচালকদের কাছে আপনার আগের সেই অবস্থানটা ওতোটা মজবুত নেই। কারণ কী?
যখন সিনেমা হিট করবে তখনই অবস্থান ধরা হয়। গতবছর আমার ছবি ওতটা ভালো যায় নাই। তাই হয়তো ধরা হচ্ছে। আগামীতে আমার ডেঞ্জার জোন, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’ মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া ‘ঢাকা ২০৪০’-র কিছু কাজ বাকি আছে। ওই সিনেমাটিও আসবে। সবকিছু মিলিয়ে এ বছর আমার জন্য বেশ ভালো। কারণ, অনেকগুলো সিনেমায় কাজ করছি। এসব সিনেমাগুলো আমার আগামীর পথ মসৃণ করবে।
ফেসবুক-ইউটিউবের জনপ্রিয় সোশ্যাল মাধ্যমে আপনার বিভিন্ন কাজ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনা বা ট্রল করা হয়। এগুলো কীভাবে দেখেন?ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ওতটা চিন্তিত নই। আমি নিজেও ফেসবুকে থাকি কম। আমি মনে করি, আলোচনায় যে আছে তাকে নিয়ে সমালোচনা হবেই। তবে চুপচাপ সবার কথা, মন্তব্য দেখি। যেটা আমার কাছে ভালো মনে হয় সেখানে নিজের ভুল থাকলে সুধরে নেয়ার চেষ্টা করি।
এতো ভাল ভাল সিনেমা করছেন কিন্তু প্রদর্শনের তো সংকট! সিনেমা যথাযথভাবে প্রদর্শনের পর্যাপ্ত সিনেমা হল নেই। কী বলবেন?
সিনেমা রিলিজ প্ল্যান সবাই মিলে তৈরি করা উচিত। কারণ, ঈদ ছাড়া মাত্র ৬৫-৭০ সিনেমা হল চালু রয়েছে। ঈদে সংখ্যাটা ২০০-এর মতো হয়। বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে ছবি মুক্তি দেওয়া উচিত। দু-তিনজন নায়ককে মিউচুয়ালিভাবে ঠিক করতে হবে এক সিনেমা রিলিজ হলে পরে অন্তত তিন সপ্তাহ যাতে অন্য সিনেমা রিলিজ না হয়। তাদের প্রযোজক এ সময় যেন ব্যবসা করতে নিতে পারবেন। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রযোজক লাভবান হলে পুনরায় আবার কাজে উৎসাহিত হবেন। আমি শুরু থেকে সিনেমা রিলিজের সময় এসব ঠ্যালাঠেলি খেয়াল করেছি। যে শক্তিশালী, কাকরাইল পাড়া যার নিয়ন্ত্রণে সে বেশি সিনেমা হলে মুক্তি দিচ্ছে। অন্যজন কম হল পাচ্ছে। এমন না করে মিউচুয়াল থাকলে উৎসব ছাড়া ছবি রিলিজ দিয়েও উৎসব বানানো যায়। যেমন মার্ভেল এবং ফক্স! তারা কখনোই একসঙ্গে সিনেমা রিলিজ দেয় না। আমাদের দেশেও এমন হওয়া উচিত। এই দুই সপ্তাহ উমুক নায়কের সিনেমা চলবে, পরের দুই সপ্তাহ তমুক নায়কের সিনেমা চলবে। এমন ঘটলে যতগুলো সিনেমা হল থাকবে সবগুলোতে একই নায়কের সিনেমা চলবে। পাবলিসিটিও সে একাই পাবে।
দিনের পর দিন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিষয়টি ভাবায় আপনাকে?
প্রতিটি সেক্টর যখন রেভল্যুশনের (বিপ্লব) সময় যখন হয় তখন অনেকদিক থেকে ভাঙন শুরু হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে আমি এসেছি ২০১২ সালের দিকে। তখন অবস্থা ছিল মৃতপ্রায়। আমি যখন এসেছি তখন শাকিব ভাইয়া ছাড়া তেমন কেউ সিনেমার শুটিং করতো না। আমি দেখেছি একজন ছাড়া তেমন কোনো হিরোই ছিল না! ওই সময়ে শুটিং শুধু আমি এবং ভাইয়া করতাম! তখন ডিজিটালি অনেকেই খাপ খাইয়ে সিনেমা বানাতে পারতেন না। ওই সময় ইন্ডাস্ট্রিতে আমার আগমন একটা রেভল্যুশনের মতো ঘটনা। কয়েক বছর পর আবার খারাপ সময় আসার শুরু হয় পলিটিক্সের মাধ্যমে। ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি জড়িয়ে আছে। এজন্যই এতো খারাপ অবস্থা। ২০১৬ সালের পর থেকে এই বাজে ধাক্কা আবার লাগে। ওই বছরও ২৫০-৩০০ সিনেমা হল ছিল। ২০১৪-১৫ সালে শাকিব ভাইয়ের একটা সিনেমা এবং আমার দুইটা সিনেমা রিলিজ হয়েছে। সিনেমা হল ছিল তখন ৩০০ বেশি। তার ‘হিরো দ্য সুপারস্টার’-এর সঙ্গে আমার ‘হানিমুন’, ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ সিনেমা রিলিজ হয়েছিল। ২০১৬ সালের পর যত বড় সিনেমাই আসুক না কেন সিনেমা হল কমতেই শুরু করলো। তাই আমাদের আবার একটা বড় রেভল্যুশন দরকার।
পাশের দেশে অল্প বাজেটে সিনেমা বানিয়ে কোটি টাকা আয় করছে। আমরা কেন পারছি না?
সিনেমা হলে মানুষ আনার পরিবেশ আগে তৈরি করতে হবে। মানুষ এখন ভালো সিনেমা হলে ৫০০ টাকা দিয়েও মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায়। পাশের দেশে সিনেমা দেখাটা একটা কালচার। তাদের সঙ্গে কর্পোরেট মার্কেট জড়িত, টেলিভিশন স্বত্ত্ব মোটা অংকের। সেখানে সিনেমা দেখার সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। তাই মানুষ সিনেমা দেখতে নিয়মিত হলে যায়। আমাদের এখানেও এটা তৈরি করে দিতে হবে। মানুষ এখন ছারপোকার কামড় খেয়ে সিনেমা দেখতে পারে না।
চলচ্চিত্রে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন সেটা কতটুকু পূরণ হয়েছে?
চলচ্চিত্রকে আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয়। একজন মানুষ চাইলেই নায়ক হতে পারেন না। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে বাপ্পীকে আলাদা করা যায়। বাপ্পী হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার আমি সেটা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। নায়ক হওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার, সেটা আমি পেরেছি। অনেক বড় সুপারস্টার হওয়ার স্বপ্ন কখনোই ছিল না। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, মানুষ আমাকে ভালো বলুক। চলচ্চিত্রে ঘোড়া দৌড়ে খেলতে হলে আমাকে চামচামি করতে হতো। কিন্তু আমি এসব করতে প্রস্তুত নই।
দুটো স্বপ্নের চরিত্র বলুন। যেখানে কাজ করতে চান?
ক্রিকেটার এবং আর্মি অফিসার। এ দুটো আমার স্বপ্নের চরিত্র। কিন্তু এখনও করতে পারিনি।
অনেকেই বলেন আপনার অভিনয় কিছুটা দুর্বল! আরও মনোযোগী হওয়া দরকার। কী বলবেন?
যারা এ কথা বলে তাদের আমার সিনেমা দেখেই কথা বলা উচিত। আমার জানার ইচ্ছে, তারা আমার কী কী সিনেমা দেখেছে? যারা এটা বলে ইনটেশন থেকে বলে। তাদের জানা উচিত, অভিনয় যত করবো ততো অভিজ্ঞতা বাড়বে। যারা এটা বলে তাদের সুইটহার্ট, সুলতানা বিবিয়ানা, অনেক দামে কেনা, অন্যরকম ভালোবাসা, অনেক সাধের ময়না, হানিমুন এসব সিনেমাগুলো দেখার পরামর্শ দিলাম। এই বাজে রব উঠেছিল ‘ভালোবাসার রঙ’ থেকে। দর্শনধারী গুণটা শুরুতেই আমি দেখিয়েছিলাম।
কিন্তু বেশ কিছু মানহীন সিনেমায় তো আপনি কাজ করেছেন। ওগুলো নিয়ে কী বলবেন?
কিছু মানহীন সিনেমা করেছি ঠিক। যেসব পরিচালকের সঙ্গে একাধিক কাজ করেছি, তাদের সঙ্গে কাজ করে এগুলো হয়েছে। যখন কাজে যাই ডিমোশন হলে কিছু করার থাকে না। এজন্য নিজেকে ওভারকাম করার জন্য অনেক সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি। টাকাও ফেরত দিয়েছি। সাফি ভাইয়ের ‘সিক্রেট এজেন্ট’ করছি এখন। এর আগে তার সঙ্গে হিট সিনেমা করেছি। এবার যদি ভালো না বানায় দোষটা আমার হবে। কারণ, সিনেমাটি বিক্রি হবে আমাকে দেখে। সবমিলিয়ে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।