রাজনীতিতে আড়ালে আবডালে অনেক কিছু হয়, অনেক কিছু ঘটে। মুহূর্তেই রাজনীতিতে বিশ্বাস নষ্ট ও ভঙ্গ হয়। বিশেষ করে নির্বাচন এলে নানা হিসেব নিকেশ আর লোভ লালসার কারণে বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা বেশি ঘটে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলায় ঘরের ছেলেরা যেমন ছুটে যায়, তেমন সুবিধাবাদী দুষ্টরাও এসে ঢুকে পড়ে।
এবারের নির্বাচনেও সেই চিত্র দেখা গেছে। আবারো প্রমাণিত হয়েছে রাজনীতিতে আসলেই শেষ বলে কিছু নেই। একথাটি যুগ যুগ ধরে ধ্রুপদ সেটাই সত্য হলো। সেই সত্য এবারের নির্বাচনেও প্রদর্শিত হয়েছে আরও নতুন করে। বঙ্গবন্ধুর একসময়ের ‘স্নেহধন্য’দের ধানের শীষ নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী যুদ্ধে হাজির হওয়া মহাবিস্ময়কর ঘটনা বললে ভুল হবে না।
ড. কামাল হোসেন, আসম আব্দুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর-বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সব সন্তান। রেজা কিবরিয়া সাবেক প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছেলে। তার হত্যার সাথে জড়িত বিএনপির নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর সাথে ড. কামাল হোসেন, আসম আব্দুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরদের (রেজা কিবরিয়া ছাড়া) রজনীতির মধুর স্মৃতি রয়েছে। যাদের রাজনৈতিক আভিজাত্যের বড় অংশ তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যেই।
জনগণ স্বপ্নেও ভাবেনি উল্লিখিতরা জিয়ার ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতি বন্ধুদের সাথে নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে থাকবেন। কিন্তু সবাই এখন ধানের শীষের জন্য জানবাজি রাখছেন। রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কখনই তারা ধানের শীষের ধারের কাছেও ছিলেন না। বিস্ময়টা এখানেই! বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের উপর যতই অভিমান করুক তাই বলে ধানের শীষ বুকে জড়িয়ে রাখবেন এটা মানায় না! মেয়ে কুড়ি সিদ্দিকীর হাতে ধানের শীষ ধরিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী হিসেবে খ্যাত কাদের সিদ্দিকী।
এদিকে বিএনপি নেতা ইনাম আহমেদ চৌধুরীর হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগে যোগদানও বিস্ময়কর। শেষ জীবনে তিনি এভাবে দল পরিবর্তন করবেন এ যেনো কারো ভাবনাতেই ছিল না। জিয়া, খালেদা জিয়াকে নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখেছেন। রাজনীতিতে ইনাম আহমেদ চৌধুরী বরাবরই সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। শেষ বয়সে আওয়ামী লীগে যোগদান করে তিনি কী পাপ মোচন করলেন তা তিনিই ভালো করে জানেন।
সন্দেহ নেই ড. কামাল হোসেন, আসম আব্দুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরদের মতো নেতাদের জোটে পেয়ে কারাগারে অন্তরীণ বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিছুটা হলেও স্বস্তিতে আছেন। তবে সেই স্বস্তি কতোটা দীর্ঘ হবে সেটা বুঝা যাবে নির্বাচনের পর। অনেকটা আগামই বলা যায়, নির্বাচনের ফলাফলের উপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জোটের স্থায়ীত্ব নির্ভর করবে। নির্বাচনে ফলাফল খুব খারাপ হলে সেই দায়ভার যে ড. কামাল হোসেনদের উপর পড়বে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
তবে জোট এবং ভোটের রাজনীতিতে এখনও এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। পুরনো অনেক মিত্র এবং তার হাতে গড়া অনেক নেতা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও ১৪ দলীয় জোটের মিত্রদের তিনি একই সুতোয় বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। নানা জটিলতার মধ্যেও ১৪ দলীয় জোটের শরীকরা তার সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি। জোটের অন্যতম দুই নেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন। উল্লিখিতদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন এমপি ঢাকা ৮ (রমনা-মতিঝিল-পল্টন) এবং হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া ২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে লড়ছেন।
হাসানুল হক ইনু জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন তরুণদেরই একজন। যিনি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম দিকনির্দেশক। জঙ্গীবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সীপাহসালার। ২০০১ সাল থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ একক ও নিরলস প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দলের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা পরিচালনা করে এবং ‘জাতীয় ঐকমত্য’-এর ভিত্তিতে ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন ও ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ পরিচালনা’র রাজনৈতিক আবশ্যিকতার গুরুত্ব তুলে ধরে। এ সময় সারা দেশে বিএনপির সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে অনেক জঙ্গিগোষ্ঠী; গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তির ওপর হামলা পরিচালনা করতে থাকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালাতে থাকে, এমনকি বিরোধী দলীয় নেতাকে হত্যার লক্ষ্যে তার ওপর গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করে। এ সময় ‘একলা চল’ নীতির বিপরীতে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরও নিবিড়ভাবে অনুভূত হয়।
অবশেষে ২০০৫ সালে গঠিত হয় ‘১৪ দল’। জাসদ প্রস্তাবিত ‘ন্যূনতম জাতীয় কর্মসূচি: পরিবর্তনের রূপরেখা ও অঙ্গীকার’-এর ভিত্তিতে প্রণীত হয় ১৪ দলের ২৩ দফা। ১৪ দল গঠনে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরবর্তী নির্বাচনে ১৪ দলের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হয়।
বর্তমান যে ১৪ দলীয় জোট সেটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি, আবার এই জোট কেবল ক্ষমতা যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দিক থেকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্যের কিছু সুনির্দিষ্ট রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. বিএনপি-জামায়াত এবং এদের মিত্র জঙ্গীবাদী-মৌলবাদী-উগ্রবাদী-সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে রাখা, ২. বিএনপি-জামায়াত এবং এদের মিত্র জঙ্গীবাদী-মৌলবাদী-উগ্রবাদী-সন্ত্রাসবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ৩. রাষ্ট্র-সংবিধান-রাজনীতি-সমাজ অঙ্গন থেকে সামরিক শাসকদের রেখে যাওয়া জঞ্জাল পরিস্কার করা।
রাজনীতির ময়দানে ইনু-মেননকে নিয়ে কম কথা হয়নি। এখনও সুযোগ পেলেই কাদের সিদ্দিকীর মতো বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্যরা এক হাত নিতে ভুল করেন না। শেখ হাসিনার কাছ থেকে ইনু-মেনন এ দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে যড়যন্ত্রও কম হয়নি। কিন্তু ইনু-মেননরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের জোটকে অটুট ও ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী রেখেছেন। জোট ও ভোটের রাজনীতিতে ইনু-মেননদের বিশ্বস্ততা, দৃঢ়তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)