৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং অভিযুক্তকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পরোয়ানার বিধান রেখে জামিন যোগ্য করা হয়েছে।
এই একটি বিষয়কে ইতিবাচক উল্লেখ করলেও নতুন আইনে চতুরতা আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক। আর এই ধারাসহ নতুন আইনটিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পূর্ণাঙ্গ ভাবে পড়া হয়নি তাদের। তবে আপাতত সরকারি ব্রিফিংয়ে পাওয়া তথ্য থেকে তারা ধারণা করেন, ৫৭ ধারায় জন্ম নেয়া শঙ্কাগুলো নতুন আইনে দূর হচ্ছে না।
বিচিত্র সাইবার অপরাধের এই সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়ন করা এবং ২৯ ধারার শাস্তির বিধানকে ইতিবাচক জানিয়ে ড. ফাহমিদুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে কোন কোন জায়গায় শাস্তি বাড়লো, আবার কোন কোন জায়গায় শাস্তি কমলো। মানহানির বিষয়টিকে জামিন যোগ্য করাকে সাধুবাদ জানাই। আরেকটি বিষয়ে সাধুবাদ জানাতে চাই। সেটি হচ্ছে ডিজিটাল পরিস্থিতিতে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন আইন প্রয়োজন ছিলো। সেটা হয়েছে।
‘তবে মত প্রকাশে বাধার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে,’ জানিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ৫৭ ধারা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল সেটি নতুন আইনেও রয়ে গেছে। ৫৭ ধারার মূল বিষয়গুলো ভিন্ন নামে থেকে গেছে। এটা সরকারের দিক থেকে একরকম চতুরতা। অনলাইনে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের শঙ্কা থেকেই গেলো।
‘সব মিলিয়ে আমরা ৫৭ ধারা থেকে মুক্তি পেলাম না। এখানে জনগণের সুরক্ষার বদলে সরকারের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবকে একটি আইনি কাঠামো দেয়া হলো বলে মনে হচ্ছে।’
নতুন আইনে মত প্রকাশে বাধার শঙ্কার সঙ্গে ব্যাখ্যা-সংজ্ঞাগত অস্পষ্টতা থেকে গেছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ৫৭ ধারাকে যেভাবে ব্যবহার করে হয়রানি করা হচ্ছিল এখন বিস্তৃতভাবে নতুন ধারাগুলো দিয়ে নতুন আইনে আরও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ তৈরি করা হলো। ৫৭ ধারার মতো নতুন আইনেও কয়েকটি উপাদানের বিস্তারিত আইনী ব্যাখ্যা-সংজ্ঞায়ন নাই। যেমন- অনুভূতি, এই অনুভূতি কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কিভাবে বুঝবো? কোনটা করলে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে কোনটা করলে হবে না এটা কিভাবে নির্ধারিত হবে? ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত অপরাধ কিভাবে নির্ধারিত হবে?
‘আসলে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেসবের কোনটিরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বালাই নেই। এসব অস্পষ্টতার কারণে হয়রানির সুযোগ থেকে যাচ্ছে।’
কারাদণ্ড ও জরিমানার মতো শাস্তিগুলোর বেলায় অসামঞ্জস্যতা রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন: এখন মানহানির জন্য আগের শাস্তি কমানো হয়েছে। কিন্তু দেশে তো ইতোমধ্যে মানহানির মতো অপরাধের বিষয়ে আইন আছেই। সেখানে অনলাইনে কেউ মানহানি করলে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে শাস্তি কেন প্রচলিত আইনের চেয়ে এক বছর বেশি হবে? এই এক বছরও বড় একটি বিষয়।অর্থদণ্ডের বেলাতেও রয়েছে অসঙ্গতি।
এমনকি জনসাধারণের মতামতের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের যে খসড়া দেখানো হয়েছিলো সেটির সঙ্গে অনুমোদন পাওয়া আইনের পার্থক্য রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন: পেশাগত জায়গা থেকে আইনটি নিয়ে কথা বলার আগে সামনে আইনটি থাকা উচিৎ ছিল। হতাশাজনকভাবে সেটা আপাতত নেই। অনুমোদনের পর মন্ত্রী পরিষদ সচিবের ব্রিফিং থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছি। যে খসড়াটি জনসাধারণের মতামতের জন্য দেয়া হয়েছিলো সেটির সঙ্গে অনুমোদন পাওয়া আইনটির মধ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যে খসড়াটি নিয়ে আমরা ২০১৬ সালে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এবং স্বয়ং আইনমন্ত্রীর সামনে কথা বলেছি সেটি এবং অনুমোদন পাওয়া খসড়াটি এক না।
অনলাইন নির্ভর এবং সামাজিক মাধ্যমের এই সময়ে ছদ্মবেশী ৫৭ ধারা আদলের যেকোন দমনমূলক আইনের বিরোধিতা করেছেন অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক এবং ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
ইন্টারনেটে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধের দমন, প্রতিরোধ ও বিচারের জন্য ২০০৬ সালের আইসিটি আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করে ৫৭ ধারা যুক্ত করা হয়। আর সার্বিকভাবে ডিজিটাল অপরাধগুলোর প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন ও বিচারের জন্য এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে।
২০০৬ সালের বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালে সংশোধন করে ৫৭ ধারা যুক্ত করা হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ওই আইনের ধারার অপপ্রয়োগে সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ ক্রমাগত হয়রানির শিকার হতে থাকলে ধারাটি বাতিলের দাবি ওঠে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেই ৫৭ ধারা বাতিল করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়।