বঙ্গীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে আত্মহত্যার অবস্থান জরিপযোগ্য নয়। এই জটিল এবং দুর্বিগাহ বিষয়টি এদেশের ভাববার মতো প্রেক্ষিত রচনা করতে না পারার প্রকৃত কারণ বোধ হয় বাঙালির উদ্বেগহীন জীবন যাত্রার নিস্তরঙ্গ বোধ। অথচ জীবন যে দুঃখময়, প্রাচ্যের এই অংশে সেই উপলব্ধি যেমন উচ্চারিত হয়েছে তেমনি এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় খোঁজার ইতিহাসও আমাদের অজানা নয়। আত্মনিষ্ক্রান্তির পথে দুঃখের নিবৃত্তি হয় না বা বিষাদ থেকে মুক্তি মেলে না, জন্মান্তরবাদী বৈদিক মন্ত্রে বা বুদ্ধের বাণীতে সেই দীক্ষা নেই। আর ইসলামে আত্মহত্যা তো মহাপাপ। যদিও বিবিধ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কারণে ‘ইচ্ছামৃত্যু’ বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো বাঙালি সমাজের নানা স্তরে ঘটতে দেখা যায়।
জীবন দুঃখময় ও নিরর্থক একথা স্বীকার করেও বেঁচে থাকাকে তীব্রভাবে ভালোবাসে মানুষ- অকথ্য বেদনা সয়ে, দুঃসহ গ্লানি ও অমোচনীয় অনিশ্চয়তার কথা জেনে, গতানুগতিক জীবনের দুর্বহ ভার বয়ে বয়ে শেষ পর্যন্ত। আশ্চর্য হতে হয়, প্রতিদিন কোটি কোটি প্রাণীর অনিবার্য পরিণতি মৃত্যুকে সামনে রেখে জীবিতের বাঁচবার উদগ্রীবতায়। মনে হয় জীবনের মানে হয়তো সেখানে, মৃত্যুর অর্থ যেখানে কারো কারো কাছে গন্তব্য আর কারো কারো কাছে অব্যাহতি; মৃত্যু-মন্থনতা বস্তুত আত্মোপলব্ধিরই ফল। সম্ভবত অস্তিত্বের যথার্থ উপলব্ধি আর এ অমিত সম্ভাবনাকে সার্থক করার এটা একটা প্রবল মানসিক উদযোগ। জীবনের এমন অপ্রতিরোধ্য স্ফুরণের সামনে তবে কোন শক্তিতে দাঁড়ায় আত্মহনন? কীভাবে এর ব্যাখ্যা মিলবে? যারা আত্মহত্যা করেন তাদের মনোজগতের গঠনটিই বা কেমন? ভালবাসা-আবেগ-অভিমান নিয়ে কেমন মানুষ তারা? উপলব্ধির কোন পরিস্থিতিতে এসে মানুষ আত্মঘাতি হবার চরম সিদ্ধান্তে অটল হতে পারে? আবার বেঁচে থাকার উল্টোদিকে দাঁড়াবার এই অদম্য সাহসও তো জীবনের আর এক সম্ভাবনা, খুব কম জনই তো যে সাহস দেখাবার হিম্মত রাখে।
এ নিয়ে কৌতুহলের যেমন অন্ত নেই; লেখালেখি, গবেষণা, ভাবনাচিন্তাও হয়েছে প্রচুর। ইতিহাস ঘেটে, সমাজ সংলগ্ন বিবিধ বিষয়ের বিশ্লেষণী তথ্য উপাত্ত নিয়ে, মনোবৈজ্ঞানিক প্রামাণিকতা হাজির করে প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র আর ভারি ভারি গ্রন্থের সমাবেশ ঘটিয়ে আবির্ভূত হয়েছে নতুন ক্ষেত্র বিভাগ- সুইসাইডোলজি বা আত্মহত্যাবিজ্ঞান। আবার আত্মহত্যার বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব অবস্থা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে। শুধু তা-ই নয়, আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও নিবারণের জন্য গড়ে উঠেছে বহু প্রতিষ্ঠান, প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি; যার আওতায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের চিহ্নিত করে, সতর্ক করে প্রয়োজনায় চিকিৎসা দিতে। বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার স্বল্প আয়ের অনুন্নত সমাজে যা এখনো অকল্পনীয়। তাই বলে জিজ্ঞাসা থেমে নেই, অনুসন্ধিৎসু মনের তৎপরতাও লক্ষ্যযোগ্য। যার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উদাহরণ কবি প্রাবন্ধিক কুমার চক্রবর্তীর অসামান্য গ্রন্থ অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা। জানা মতে বাংলা ভাষায় আত্মহত্যা নিয়ে পরিশ্রমী ও গবেষণালব্দ এ রকম কাজ আগে আর একটাও হয়নি।
বারোটি প্রবন্ধের বইটিতে লেখক কুমার চক্রবর্তী আত্মহত্যার ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে শুরু করে এর ধারাবাহিক অনুসন্ধানেই লিপ্ত থাকেননি, বিষয়টিকে সম্ভাব্য সব কোণ থেকে অবলোকনের চেষ্টা চালিয়েছেন। উত্তর খুঁজেছেন কিছু মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নেরও। জীবন বলতে কি বুঝি, মৃত্যুর ভূমিকা কতোটুকু, অস্তিত্বের কোনো অর্থ আছে না এর পুরোটাই নিরর্থক? জীবনের আদি ও অন্তের প্রশ্নে আদৌ কোনো অর্থ আছে কি নেই? আর এ কারণেই তাকে বিপুল ধৈর্য্য নিয়ে অনবরত খুঁড়তে হয়েছে পুরাণ, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান সর্বোপরি প্রাচীন থেকে আধুনিক সাহিত্যের অলিগলি। প্রতিটি প্রবন্ধে পড়াশোনার দীর্ঘ পরিসর ও পরিশ্রমের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে বিপুল তথ্য উপাত্তের উল্লেখে, একাডেমিক প্রয়োজন ছাড়া যার নজির খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বইটিতে আছে এমন অসংখ্য বিষয়ের উল্লেখ, সংশ্লিষ্ট বিস্তর জানা-অজানা তথ্যের সন্নিবেশে যা প্রতিপাদ্যের ব্যাপ্তিকে শুধু বিস্তৃতই করে না, পাঠকের মনোজগৎকে টেনে নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে, বিশেষ করে সাহিত্যের পরিমণ্ডল থেকে যখন তিনি উদাহরণ হাজির করেন।
‘হয়তো মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয়।’ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার এই উল্লেখ মানুষের অমরত্বের কথা যেমন স্মরণ করিয়ে দেয়, পাশাপাশি দার্শনিক হাইডেগার থেকে নিয়ে লেখক উদ্ধৃত করেন- ‘মৃত্যু হলো এক সম্ভাবনা- মানুষ তাই মৃত্যুর কাছে নিক্ষিপ্ত, মানুষ এই সম্ভাবনাতে নিক্ষিপ্ত। মৃত্যু মানুষের অস্তিত্বের অনিবার্য সম্ভাবনা এবং তা শর্তহীন। মৃত্যু হলো জগতের কাছে অস্তিত্বহীন হওয়া- ছিল এখন নেই।’ ‘জীবন ও মৃত্যু’, ‘অস্তিত্বও নিরর্থকতা’ নিয়ে এভাবেই এগোতো থাকেন কুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথ হয়ে টমাস মান, জীবনানন্দ হয়ে ফ্রয়েড, কাফকা, কামু, কিয়ের্কেগার্দ, সার্ত্রে পর্যন্ত।
‘আত্মহত্যার দার্শনিক ব্যাখ্যা কী? অথবা কী তার মনস্তাত্ত্বিক উপযোগিতা? আত্মহত্যা কী জীবনকে অস্বীকার নাকি মৃত্যুকে ভালোবাসা? অথবা মৃত্যু যখন অমোঘ এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে তখনই কি মৃত্যুর জানালা এক-এক করে খুলে যায়- যার দূর চারণভূমি ইশারায় ডেকে নিয়ে যায় তার গভীর অন্তঃপুরে?’ কুমার এরকম প্রশ্ন তুলে ‘মৃত্যু এক আত্মহত্যা’ অনুচ্ছেদটি শুরু করেন ইলিয়াড-এর গল্প দিয়ে এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, হিব্রু শাস্ত্র, গ্রীক পুরাণে উল্লেখিত আত্মহত্যা থেকে শুরু করে শাসক, লেখক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীর আত্মঘাতী হবার নানান ঘটনার মধ্যে খুঁজে বেড়ান মৃত্যুইচ্ছার মর্ম। এর সাথে ১৯৩০ অব্দের এক সাক্ষাৎকারে দেয়া ফ্রয়েডের অসাধারণ কিছু উক্তি তুলে ধরেন লেখক। ফ্রয়েড বলছেন, ‘মৃত্যু মূলত নিজে কোনো জীবগত প্রয়োজন নয়। সম্ভবত আমরা মরি কারণ আমরা মরতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেমন একটি টেনে-ধরা রাবার ব্যান্ড তার আদি আকৃতিকে ফেরা প্রবণ, এই প্রবণতায় আক্রান্ত সকল জীবিত বস্তুই সচেতন বা অসচেতনভাবে আকুল থাকে পরিপূর্ণ ও পরমভাবে তার অজৈব অস্তিত্বের জাড্যাবস্থায় ফিরে যেতে। মৃত্যু-ইচ্ছা ও জীবন-ইচ্ছা আমাদের ভেতর পাশাপাশি অবস্থান করে।’ ‘মৃত্যু হলো প্রেমের বন্ধু- একত্রে তারা পৃথিবী শাসন করে’।
‘ভ্রান্তি, বিবেচনা ও যুক্তিসূত্র’ প্রসঙ্গে এসে কুমার লেখেন- ‘আদিকালে আত্মহত্যাকে সামাজিক বিবেচনায় বিচার করা হতো এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি সেক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ভূমিকাশীল ছিল। মধ্যযুগে ধর্মীয় বিবেচনা ও অনুশাসন দ্বারা বিষয়টি পুরোপুরিভাবে দেখা হতো এবং একে বাতিল করা হতো আর আধুনিকালে এসব কিছুর ওপর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতে লাগল আর তা গ্রহণীয় হতে শুরু করল। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও অন্বেষণে আত্মহত্যাকে বিচার-বিশ্লেষণ ও অবলোকনের কাজ শুরু হলো। যদিও আত্মহত্যা এখনো হতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে সংস্কার ও সন্দেহমুক্ত তবুও একদা যা ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধ এবং প্রাণঘাতি পাপ- এক্ষণে তা ব্যক্তিগত দোষ বা সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে লাগল।’
বিস্তর পথ ঘুরে এসে এখানে একটা সিদ্ধান্তের মতোই কি ইচ্ছামৃত্যুর ঐতিহাসিক বিবর্তনের কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক? যেভাবেই উপস্থাপন করুন না কেন গোটা বিষয়টাকে গুছিয়ে তোলা হয়ে ওঠে না, অন্তহীন অনুসন্ধানের আকুতিও যেন কাটে না তার। এক্ষণে কুমার ঘোষণা দেন- ‘আসলে জীবন ও মৃত্যুর মিলিত সিম্ফনিই হলো আত্মহত্যা’। এটা নিছক সাহিত্যিক প্রত্যয়। কিন্তু দার্শনিক ইয়ূঙ যখন বলেন- মানব মন হলো সকল শিল্প ও বিজ্ঞানের জরায়ু, এখান থেকেই জন্ম নেয় শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন-চিত্রকলা। তখন শুধু আত্মহননের আদ্যোপান্ত খোঁজার বেলায়ই নয়, মানব মনের তল খুঁজে হিসাব মেলানোর মতো জটিলতায় আটকে যেতে চায় লেখক চক্রবর্তীর তাবৎ চিন্তাজগৎ। তাই মনস্তাত্তিক চর্চার ভেতর দিয়ে যাদের জীবন অতিবাহিত সেরকম খ্যাতিমান সৃষ্টিশীল ৪৮ জন মানবের (যাদের নাম দিয়েছেন মাত্রামানব) আত্মহননের আগের পরের পরিস্থিতি, দিনক্ষণ, ঘটনাক্রম, এ নিয়ে তাদের লিখে রেখে যাওয়া টুকিটাকিসহ তাদের মৃত্যুর মনস্তাত্তিক ফলাফলকে তুলে ধরতে গিয়ে কুমার চক্রবর্তী বলেন- ‘ফলাফল যদিও এক তবুও তার উপক্রমণিকায় বিভাব আছে- মাধুর্য ও মাত্রিকতা আছে। এই মাত্রামানবদের মৃত্যুর রূপ-নকশাকে আমরা খতিয়ে দেখতে পারি।
স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু অনাদৃত কিন্তু এই মাত্রামানবরা কখনো স্বজ্ঞানে কখনো অবচেতনে অনরবত নিজেদের মৃত্যুর আঙ্গিককে নির্ধারিত করেছেন। কখনো সুস্থির মনোপ্রবণতায় ঘটনার বহির্কাঠামোকে রূপায়িত করতে আন্তরিক হয়ে ওঠেন তারা, কখনোবা অপরিণামদর্শীভাবে মুখোমুখি হন ঘটনাদিগন্তের। যা কিছুই হোক তারা প্রেরণা পেয়েছেন তাদের অবচেতন থেকে। অবচেতনের এক সংহত আচ্ছন্নতায় অবশেষে তারা ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছেন। হেল্যুসিনেশন আর ভ্রমাত্মক চিন্তার সহযোগে অবশেষে তারা করে বসেন আসল কাজটি। অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে লালন করেন আত্মহত্যাকে, নির্ধারণ করতে সচেষ্ট থাকেন প্রকৃত দিনক্ষণটির।’
কিন্তু ‘মাত্রামানব’- আত্মহননকারীকে দেয়া এই গুরুত্বপূর্ণ অভিধাটি, যা ইচ্ছামৃত্যুকাঙ্খির অন্তর্নিহিত সামূহিক পরিচয়কে তুলে ধরতে সক্ষম, যথাযথ ব্যাখ্যার অভাবে এবং মাত্রাহীন তথ্যের ভারে ততোটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। যে জন্যে অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা নিয়ে গ্রন্থালোচনায় কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল লিখেছেন- ‘নিজ জীবনের সীমাকে যারা নির্দিষ্ট করে দেয় তারা মাত্রামানব, লেখক হয়তো সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু চারমাত্রার স্থানকালের সঙ্গে মিলিয়ে জীবন-মৃত্যুকে একমাত্রা হিসেবে বর্ণনা করার কারণ বোঝা গেল না। বিজ্ঞানের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা আলাদা, খুব কম সময়েই এই দুটো ভাষা একই অর্থ বহন করে, বিজ্ঞানের ভাষায় মাত্রা আর সাহিত্যের ভাষায় মাত্রা একই অর্থ বহন করে না। ধারণা করি, শব্দের অর্থগত তারতম্যের বিষয়ে সচেতন না হওয়ার ফলে লেখক বিভ্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে একটি মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’ আহমাদ মোস্তফা কামালের এই উক্তির সাথে দ্বিমত রেখে বলতে চাই, গাণিতিক নিশ্চয়তা দিয়ে মাত্রামানব অভিধার উদ্দেশ্যকে মাপটা বোধহয় ঠিক হবে না। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপর্যাপ্ততা থাকতে পারে। আর সে কারণেই মাত্রামানব নিয়ে একটা বিভ্রান্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে হয়তো। কুমার চক্রবর্তী অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, সাহিত্যিক অনুপ্রেরণায় রচিত বিজ্ঞান শ্রয়ী সামাজিক অনুসন্ধান মাত্র। ‘সাহিত্য ও আত্মহত্যা’ এবং ‘সমাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও বঙ্গীয় কয়েকজন অন্ধকার’ অংশে এসে কুমার বলেন, ‘সাহিত্যে আত্মহত্যাও মূলত জীবন ও মৃত্যুর যুগল সন্নিপাত। প্রাচীনকাল থেকেই আত্মহত্যা একটি মৌলিক বিষয় বা অনুষঙ্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাহিত্যে।’ এরপর পাঠকের আগ্রহ আর জিজ্ঞাসাকে উসকে দিতে কুমার বিশ্বসাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্য তন্নতন্ন করে তুলে ধরেন অজস্র মাত্রামানবের উদাহরণ, ইচ্ছামৃত্যুর সাতকাহন, মৃত্যুবিষয়ক কথাকতা। এখান থেকে কবি জীবনানন্দের একটি কবিতার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় কবি আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিত করেছেন, এক ভিন্নতর অর্থবহ কারণের কথা বলেছেন, তিনি- নারী-প্রেম-শিশু-গৃহ-অর্থ-কীর্তি সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কেন একজন আত্মহত্যা করে? করে কারণ ‘এক বিপন্ন বিস্ময়’ তার রক্তের ভেতর খেলা করে, ফলে সংলিপ্ত ক্লান্তি থেকে পাওয়ার জন্যেই সে আত্মহত্যা করে, কারণ, ‘লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই’।
আহমাদ মোস্তফা কামালের আলোচনাতেই আশ্চর্য একটা তথ্য পেয়েছিলাম। জানামতে বাংলাদেশে এরকম ঘটনা আর নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ইচ্ছামৃত্যু এবং এর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণের ওপর গবেষণাপত্র জমা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গবেষণাপত্রটি শিক্ষকদের যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। এরকম একটা সংবাদে নাড়াখাওয়া কামাল লিখেছেন ‘কোনোভাবেই একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না- তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন কেন? আর যদি করবেনই তাহলো একেবারে কাজটাজ শেষ করে, থিসিস জমা দিয়ে করতে গেলেন কেন? গবেষণাটি করতে করতে তার মনোজগতে কী এমন পরিবর্তন এসেছিলো? আত্মহত্যার পক্ষে কী খুব শক্ত কোনো যুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি? মনে কি হয়েছিলো যে, জীবনের যাবতীয় জটিলতা ও অর্থহীনতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে আত্মহত্যা? নাকি আগে থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা ছিলো তার মধ্যে এবং এজন্যই এই বিষয়টিকে বেছে নিয়েছিলেন গবেষণার জন্যে’? আত্মহত্যার বেলায় কামালের মতো এ রকম বেদনাহত প্রশ্ন আমাদেরও। আর কবি কুমার চক্রবর্তী নিজগুণে বিপুল পরিশ্রমে বাংলাভাষার বিরল গ্রন্থ অস্তিত্ব ও আত্মহত্যায় এই প্রশ্নের পরিধিকে যেমন বাড়িয়ে তুলেছেন তেমনি দীর্ঘসময়ের ঐতিহাসিক রূপ ও প্রেক্ষিতসহ আত্মহত্যা সংক্রান্ত নানাবিধ উপস্থাপনা দিয়ে সমৃদ্ধও করেছেন।
অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা
কুমার চক্রবর্তী
প্রকাশক: সংবেদ
মূল্য: ৫০০ টাকা
৮৫/১, ফকিরের পুল, ঢাকা ১০০০
সৌজন্যে: বইনিউজ।