করোনা মহামারির মধ্যেই সব উদ্বেগ পেছনে ফেলে উয়েফা ইউরো কাপ ২০ ফুটবলের জমজমাট লড়াই চলছে। ফুটবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। প্রতি ম্যাচেই গোলের ছড়াছড়ি। এই ইউরো কাপেই কী তাহলে ইরানের আলী দাইয়ির সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে ফেলবেন পর্তুগালের ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো? এই প্রশ্ন এখন ফুটবল বিশ্বে নিত্য ঘুরপাক খাচ্ছে।
ফুটবলের আকর্ষণীয় তারকা ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদোর ঘটনবহুল ফুটবল ক্যারিয়ারে নানা রঙ ও রূপের ছড়াছড়ি। কত ঘটনা, কত রেকর্ড! আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটাও তার এখনও অধরা। তবে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর উয়েফা নেশনস লীগে যেদিন সুইডেনের বিপক্ষে দুগোল করে শততম গোলের রেকর্ড পাড়ি দেন সেদিনই এই সংশয় তৈরি হয় যে, রোনালদো ইরানের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় আলী দাইয়ির করা ১৪৯ ম্যাচে ১০৯ গোলের রেকর্ড ভাঙার নিশানা করে ফেলেছেন। তিনি এখন তাই ভীষণ উদ্যত। সর্বোচ্চ গোল করার ইতিহাস তাঁকে দখলে নিতেই হবে। এবারের উয়েফা ইউরো কাপ যেনো সেই হাতছানিই দিচ্ছে।
১৫ জুন উয়েফা ইউরো কাপের প্রথম লড়াই-এ পর্তুগাল বনাম হাঙ্গেরির মধ্যেকার খেলায় দুগোল করেন পর্তুগালের ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো। এ দুটি গোলের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁর মোট গোলের সংখ্যা এখন ১০৬। গোলের হিসেবে আর মাত্র চারটি গোল করতেই পারলেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোল করার ঈর্ষণীয় রেকর্ডটি তিনি দখলে নেবেন। এখন পর্যন্ত এই রেকর্ডটি যার দখলে সেই আলী দাইয়িও বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন। ইরানের একটি সংবাদ সংস্থাকে তিনি বলেছেন তাঁর রেকর্ড পর্তুগালের ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো ভাঙবে বলে তিনিও বিশ্বাস করেন। আর তাই তিনি তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন। এখন পর্যন্ত আর্ন্তজাতিক ফুটবলে গোলের হিসেবে সেরা দশে রয়েছেন- ইরানের আলী দাইয়ি (১০৯), পর্তুগালের ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো (১০৬), মালয়েশিয়ার মুখতার দাহারি (৮৯), হাঙ্গেরির ফ্রেন্স পুসকাস (৮৪), জাম্বিয়ার গড ফ্রে চিতালু (৭৯), ইরাকের হুসেন সাঈদ (৭৮), ব্রাজিলের পেলে (৭৭), আরব আমীরাতের আলী মাবহুত (৭৬), কুয়েতের বাশার আবদুল্লাহ (৭৫) এবং জাপানের কুনিশে কামাতো (৭৫)।
ফুটবলে এশিয়ানদের সাফল্য ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে অনেক পিছিয়ে। ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোই ফুটবলকে শাসন করে। বিশ্বকাপ ফুটবলের লড়াই-এ এই দুই ভুবনের ফুটবলাররাই বিশ্ববাসীকে বড় বেশি উন্মাতাল করে। সেই তুলনায় পারফরমেন্সের বিচারে এশিয়ানরা সর্বোচ্চ উচ্চতায় এখনও উঠতে পারেনি। কিন্তু ফুটবলের আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলের পরিসংখ্যানে সবাইকে অবাক করে সর্বোচ্চ উচ্চতায় এখনও ইরানের আলী দাইয়ির। ১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সাল-এই চৌদ্দ বছরের ক্যারিয়ারে আলী দাইয়ি আন্তর্জাতিক ফুটবলের লড়াই-এ মোট ১০৯ গোল করে পেছনে ফেলে আসেন মালয়েশিয়ার মুখতার দাহেরি এবং হাঙ্গেরীর ফ্রেন্স পুসকাসকে। আর এই রেকর্ড করতে তিনি মোট ১৪৯টি ম্যাচ খেলেন।
আন্তর্জাতিক ম্যাচে আলী দাইয়ির অভিষেক ১৯৯৩ সালের ৬ জুন, পাকিস্তানের বিপক্ষে। সে বছর ইরানে ইকো কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রথম গোলের সূচনা ১৯৯৩ সালের ২৫ জুন। এদিন ইরানের আজাদী স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলায় চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে তিন গোল করেন। এই ম্যাচে ৬-০ গোলের ব্যবধানে জয়ী হয় ইরান। এই ম্যাচের পর থেকেই আলী দাইয়ি যেনো উড়তে থাকেন। দ্রুতই এশিয়ার শীর্ষ তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন। এরপর তাঁর পা থেকে একের পর এক আসতে থাকে গোল আর গোল। ২০০৩ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁর জীবনে আসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এদিন লেবাননের বিপক্ষে গোল করে তিনি হাঙ্গেরীর ফ্রেন্স পুসকাসের করা ৮৪ গোল পেরিয়ে এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেন। এশিয়ার দেশগুলোর বাইরে তাঁর গোল করার রেকর্ড রয়েছে কানাডা, মেক্সিকো, ইকুয়েডর, মিশর, লিবিয়া, মেসোডোনিয়া, বসনিয়া, প্যারাগুয়ে, পানামা, কোস্টারিকা। পরিসংখ্যান মতে, আর্ন্তজাতিক প্রাতিম্যাচে আলী দাইয়ির করা গোলের সংখ্যা ২৫। এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে তিনি মোট গোল করেছেন ২৩টি। এএফসি এশিয়ান কাপের ফাইনালে গোল করেছেন ১৪টি। এ ছাড়া এশিয়ান গেমসে তাঁর পা থেকে এসেছে ৯টি গোল। ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফিকেশন ম্যাচে করেছেন ৩৬টি গোল। গোল করার সাথে সাথে তাঁর পা থেকে হ্যাট্রিক এসেছে মোট আটটি। আর ক্যারিয়ারের শততম গোলটি তিনি করেন ২০০৪ সালের ১৭ নভেম্বর।
এদিকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে পর্তুগালের ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদোর অভিষেক ঘটে ২০০৩ সালে। প্রথম গোলটা পান ২০০৪ সালে গ্রীসের বিপক্ষে। এখন পর্যন্ত তিনি মোট ১৭৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তার ক্যারিয়ার আরেকটু লম্বা হবে। ফলে আলী দাইয়ির রেকর্ড ভাঙার সুবর্ণ সুযোগ তারই রয়েছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলদাতা হিসেবে সেরা দশে যারা রয়েছেন এর মধ্যে কেবল ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদোই মাঠে রয়েছেন ফুল ফর্ম নিয়ে। বেশিরভাগই ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন। আর সেরা দশের পেছনে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে,ন ভারতের সুনীল ছেত্রী এবং আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার মেসি। সুনীল ছেত্রী এ পর্যন্ত ৭৪টি গোল করেছেন আর মেসি করেছেন ৭৩টি। এ দুজনের ক্যারিয়ারও খানিকটা লম্বা হবে বলেই ধারণা করা যায়। মেসি হয়ত নিজেকে আরও একটু সামনে এগিয়ে নিতে পারবেন সামনের বিশ্বকাপ পর্যন্ত।
তবে পরিসংখ্যানের বিচারে আমরা যাকেই শীর্ষে রাখিনা কেন, হাঙ্গেরীর ফ্রেন্স পুসকাসকে কিন্তু আলাদাভাবে মনে রাখতেই হবে। কেননা ৮৫ ম্যাচ খেলে তিনি ৮৪টি গোল করেছিলেন। আবার নিকট অতীতে জাপানের কামামাতো তিনিও মাত্র ৭৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৭৪টি গোল করেন। হয়ত এই ইউরো কাপেই ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো ইরানের আলী দাইয়ির রেকর্ড ভাঙতে সমর্থ হলেও ম্যাচ এবং গোলের তারতাম্যে কিন্তু তিনি পিছিয়ে থাকবেন। কেননা এখন পর্যন্ত তিনি আলী দাইয়ির চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। সেই তুলনায় আলী দাইয়ির ম্যাচ সংখ্যা অনেক কম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।