চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আ ফ ম মাহবুবুল হক: লড়াই আর নৈতিক শক্তিটাই রেখে গেলেন

ষাট ও সত্তর দশকের ছাত্র রাজনীতির এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আ ফ ম মাহবুবুল হক পরলোক গমন করেন গত ১০ নভেম্বর। ওইদিন সকালে কানাডার অটোয়ার সিভিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বরে তিনি ব্রেইন হেমারেজ-এ আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর আর বাসায় ফেরা হয়নি তার। অনেকদিন ধরেই রাজপথের এই যোদ্ধাকে জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকায় অজ্ঞাত ঘাতকদের হামলায় আহত হওয়ার পর থেকেই তার স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন নেমে এসেছিল। একসময় প্রায় স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে রাজপথের মানুষটি ধীরে ধীরে খানিকটা একাও হয়ে পড়েন। শেষে কানাডাতে স্ত্রী সন্তানের কাছেই তার শেষ ঠাঁই হয়।

১০ নভেম্বর কানাডা থেকে আ ফ ম মাহবুবুল হকের মৃত্যুসংবাদ ভেসে আসার পর তার সতীর্থ, সহযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক মহলে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তবে সেই বিষাদটা বড় বেশি ছুঁয়ে যায় সাবেক এবং বর্তমান জাসদ-বাসদ পরিবারের রাজপথ কাঁপানো তেজস্বী মানুষগুলোকে। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিত্য লড়াই করেছেন, সত্য উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি, যারা হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন তারাই বড় বেশি বেদনাহত এবং স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। কেননা তাদের সবারই স্মৃতির পাতার বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন অকুতোভয় রাজনীতিক আ ফ ম মাহবুবুল হক।

রাজনীতির ময়দানে যিনি প্রমাণ করেছেন লড়াই আর নৈতিকতাই রাজনীতির বড় শক্তি। সব ধরনের সুবিধাবাদ যার কাছে তুচ্ছ। ১০ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্রই তার চলে যাওয়া আর শূন্যতার হাহাকার ধ্বনি আঁচ করা যায়।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্রলীগের প্রিয় নেতা এবং পরে জাসদ ও বাসদের নেতা হিসেবেই আ ফ ম মাহবুবুল হক খ্যাত হন এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাসদ (মাহবুব) অংশেরই নেতা ছিলেন। ১৯৮৩ সালে এই অংশের কেন্দ্রীয় আহবায়ক হিসেবে তিনিই ছিলেন মূল নেতা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং পাঁচ দল গঠনেও তিনি ছিলেন অন্যতম একজন। 

তবে ছাত্রনেতা হিসেব তিনি ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন। ষাটের দশকে যে সব ছাত্রনেতা অসম্ভব মেধা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা দেখিয়ে সবার মন জয় করেছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি ১৯৬২ সালে স্কুল জীবনে শরীফ কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ও পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সূর্যসেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান।

৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য, ’৬৯-৭০ সালে কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ’র অন্যতম প্রশিক্ষক ও ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা সম্মেলন করলে তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে উদ্বুদ্ধ অংশের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি এই অংশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ডাকসু নির্বাচন। জাসদপন্থী ছাত্রলীগের তখন একচ্ছত্র অবস্থান দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে। ডাকসুতে জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে আ ফ ম মাহবুবুল হক ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। এই নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী ছাত্রলীগ কর্তৃক ছিনতাই হয়ে গেলে আ ফ ম মাহবুবুল হক ভিপির মুকুট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। ১৯৭৮-৮০ সালে জাসদের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। এরপর জাসদ ভেঙে বাসদ হলে তিনি বাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সর্বশেষ বাসদ রাজনীতির সাথেই তার সম্পৃক্ততা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশাসক, শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের এই অগ্রনায়কের স্মরণে গত ১৯ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক নাগরিক শোকসভার আয়োজন করেছিলেন তার সতীর্থ সহযোদ্ধারা। এই সহযোদ্ধারা সবাইই জাসদ-বাসদের রাজনীতির সাথে একসময় যুক্ত ছিলেন। শোকসভা আয়োজনে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক জাসদ নেতা আবুল হাসিব খান, মুনিরুদ্দিন আহমদ, শামছুদ্দিন আহমদ পিয়ারা, মো. খোদা বক্স চৌধুরি, মো. হুমায়ুন কবির, মো. আবদুল্লাহ এবং বাদল খান। আরো ছিলেন বাহারুল হাসান সবুজ, কবি মোহন রায়হান, শরিফ খান, মোমিনুল ইসলাম।

মূলত উল্লিখিতদের উদ্যোগেই শোকসভার আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন জাসদের যৌবনের মাঠ কাঁপানো সব নেতারা। আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়াসহ অনেকেই গিয়েছিলেন হ্নদয়ের টানে। জাসদ-বাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত আগে পরের আরও অজস্র অর্জন এসেছিলেন প্রিয় নেতাকে স্মরণ করতে। শোকসভায় আ ফ ম মাহবুবুল হক সম্পর্কে সবারই উচ্চারণ ছিল এরকম তিনি কখনো ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে আপোস করেননি। সারাজীবন মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন তিনি। দেশের রাজনীতিতে মাহবুবুল হক সাহস, সততা, সত্যবাদিতা, দেশপ্রেমের এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত। তার রাজনৈতিক মেধা, প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অনন্য।

আজকের আদর্শহীন ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিতে তার মতো আপোসহীন নেতার বড় প্রয়োজন। ৭৩ সালে জাসদ ছাত্রলীগের মুহসিন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র আব্দুর রউফ নিশতার। এর আগে ছিলেন ডাকসুর প্রতিনিধি। আব্দুর রউফ নিশতার। থাকেন গুলশান নিকেতনে। গুলশান থেকে শোকসভায় তিনিও এসেছিলেন প্রাণের টানে। মঞ্চে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাননি। ফোনে বললেন, মাহবুব ভাই এর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর দৃঢ়তার কারণেই ছাত্র রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলাম। তার মতো আদর্শবান নেতা আর আসবে না। জীবনে তিনি কিছুই চাননি।

শুধু শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। আর তাই ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সমষ্টিগত স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ধনসম্পত্তি নয়, কেবলই লড়াই আর নৈতিকতাটুকই রেখে গেলেন তিনি। আ ফ ম মাহবুবুল হকের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর সত্তর দশকের সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে জার্মান প্রবাসী জার্মান জাসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বাবু হোয়াটসআপে প্রতিক্রিয়া জানালেন এই বলে, ‘মাহবুব ভাই আমাদের মধ্যে আর নেই। আমার প্রিয়জন, বড় ভাই, সাথী, সদালাপী, সংগ্রামী, বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী অতি সাধারণ আফম মাহবুবুল হক, মাহবুব ভাই লাল সালাম।

এটা ঠিক রাজনীতিতে আ ফ ম মাহবুবুল হক বরাবরই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন। ৭৩ সালে ডাকসুর ভিপির মুকুট পেলে এই অকুতোভয় মানুষটি সমাজ পরিবর্তনে আরও বড় ধরনের পরিবর্তন হয়তো রাখতে পারতেন। একইভাবে ৯১ সালে যদি নিজ এলাকা থেকে নির্বাচিত হতে পারতেন তাহলেও রাজনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনে তিনি আরেকটি ঝাঁকুনি দিতে পারতেন।

আ ফ ম মাহবুবুল হকের মৃত্যু জাসদ বাসদের মাঠ কাঁপানো নেতাদের হৃদয় কিছুটা হলেও নতুন তোলপাড়ের সূচনা করেছে। অনেকেই আত্মমূল্যায়ন করছেন এই বলে যে, ৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যারা এক মিছিলে দাঁড়িয়েছিলেন তারা যদি সত্যিই এক সাথে থাকতে পারতেন তাহলে এদেশে কতো কিছুই না করা সম্ভব হতো। সব অন্যায়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা যেত। কিন্তু, দলভাঙ্গন, আপোসকামিতার কারণে কোনো লক্ষ্যই পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)