“আমি তো জানি না আমার স্বামীর কবর কই। তাই আমার কাছে এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলই আমার স্বামীর কবর…”। এমন একটা বাক্যের ভেতর দিয়ে শেষ হচ্ছে গল্প! অসংখ্য নারীর এই নারীর আক্ষেপ একটি লাইনের ভেতর হাজির হয়। আমাদের সময়ের হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা দীর্ঘশ্বাস হয়ে যেন আয়েশা নামের মেয়ের মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সম্প্রতি নির্মিত টেলিছবি ‘আয়েশা’। টেলিফিল্মটি নির্মিত হয়েছে আনিসুল হকের ‘আয়েশামঙ্গল’ উপন্যাস অবলম্বনে। ‘আয়েশামঙ্গল’ সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যিক পরিমণ্ডলেও আলোচিত। কারণ এটি ‘দ্য ব্যালাড অব আয়েশা’ নামে অনূদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে প্রকাশনা সংস্থা হারপার কলিন্স থেকে। বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ১৯৭৭ সালের বিমান বাহিনীর এক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাস এটি। যেখানে আয়েশা তার বর কর্পোরাল জয়নাল আবেদিনকে হারায়।
চিত্রনাট্য যেহেতু অনুপ্রাণিত, আক্ষরিক নয় তাই ফারুকীর আয়েশা একটু একটু দূরের গল্পই মনে হয়। খুব খেয়াল না করলে সময় আঁচ করা কঠিন যেন। কান খোলা রাখলে শোনা যাবে ‘আর্মির মধ্যে জাসদ ঢুকে গেছে’। এই বাক্য হয়তো কিছুটা ইশারা দেয়, আর ইশারা পাই বাংলাদেশের হয়ে যাওয়া বিমান বিদ্রোহের মারফত। বাংলাদেশ পর্বের একটা ভাঙ্গা গড়ার সময়, চরম অবিশ্বাস, রাজনৈতিক অবক্ষয়, হানাহানি, ক্যু পাল্টা ক্যুর সময়ের একটা গল্প এখানে ‘আলাদা’ করে ফারুকী দেখান। যেখানে একটি পরিবার দিয়েই যেন বাংলাদেশের চেহারা দেখানো হয়েছে।
আনিসুলের গল্পে যেখানে ঘটনাটি সুনির্দিষ্ট সেখানে ফারুকী ভেঙ্গে দিতে পেরেছেন সময়। আয়েশার আর্তনাদ মিশিয়ে দিতে পেরেছেন সমসাময়িক বাংলাদেশের যে কোন আয়েশার আর্তনাদের সাথে। ঐ রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ হয়তো তার চেহারা পাল্টে অন্য চেহারায় হাজির হয়েছে কিন্তু এখানে অবিচার অন্যায়ের চেহারাটা প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। মানুষ যে কোন সময় সুন্দর মুহূর্তে স্ত্রীর পাশ থেকে উঠে যাবে, কিন্তু আর আসবে না। আসবে না, আসবে না। মানুষ সুখ থেকে এক নিমিষে তীব্র অসুখে নিমীলিত হবে। বিতাড়িত হবে তার কাঙ্খা থেকে। ফলে আমরা দেখব মানুষের মুখ থেকে বের হবে, “উকিলরে বলবেন এমন করে আপিল করতে, অরে বাঁচালেই চলবে। চাকরি বাঁচানোর দরকার নাই।”
অনন্ত একটা ভীতি যেন আমাদের দৌড়াচ্ছে। এখানে জীবনের মতো আর কিছু নাই। সম্পদ, যাপনের নিশ্চয়তা এখানে তুচ্ছ। জীবনটা থাকলেই মানুষ খুশি। এই অবিরাম জীবনের নিরাপত্তাহীনতা ফারুকী সময় ভেঙ্গে হাজির করতে পারেন আয়েশায়। আমরা দেখি মানুষেরা অসহায় অমানুষের মধ্যে। ফলে বুড়ো লজ্জা পায় ২৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা যখন তাকে অমানবিক করতে পারে না! মিথ্যা আর মিথ্যাই তখন সত্যর বিকল্প। আগত মানুষে প্রতিক্ষার কাল্পনিক এক খুশ আমদেদে লজ্জিত বৃদ্ধ নিন্মপদস্থ বাহিরে-ভেতরে! জয়নালের জেলে আমরা। আয়েশা এক আর্তনাদ। যেখানেই হাত তোলা যায়, সেখানেই জিয়ারতের সুযোগ।
দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে ফারুকীসুলভ মুনসিয়ানা ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভবত একটা বড় চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। এমন কি শেষ পর্যন্ত বিমান কর্মকর্তাদের যে ভবন ও যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা অনেকটা মলিন। বিমান বাহিনী বা আমাদের যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর যে সাধারণ চাকচিক্য তার উপস্থিতি ছিল না মোটেই। যেন সব মলিন ধূসর। এই টেলিছবিতে শহরতলীর মেয়ে আয়েশে। সময়ের বিবেচনা করলে সত্তুরের দশক। সেই অর্থে স্বামীকে হারিয়ে অসহায় একজন মেয়ে আয়েশা! কিন্তু স্থিরতা ধীরতা দৃঢ়তা নিয়ে অনন্য সাধারণ এক নারী আয়েশা!
আয়েশা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিশা। এমনিতেও সাম্প্রতিক সময়ে তিশার অভিনয় চোখে পড়ার মতো। সেখানে একটু পুরাতন সাজে তিনি ছিলেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য। একটু নাদুস মুখ তাকে অ্যাডভান্টেজ দিয়েছে আরও। মেকাপ গেটাপ মানানসই। সাথে চঞ্চল যতোটা সময় ছিলেন যথারীতি ভালো অভিনয় করেছেন।
যাদের উপন্যাসটা পড়া নাই, বা যাদের আছেও তারা যদি উপন্যাসটা মাথা থেকে নামিয়ে টেলিফিল্মটা দেখেন তাহলে মনে হয় বেশি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। ফারুকী এই নির্মাণে স্থানিক-কালিক দূরত্ব হ্রাস করেছেন অনেকটাই। এই কারণেই সম্ভবত টেলিফিল্মটি এখনকার সাম্প্রতিক বাস্তবতার খুব কাছাকাছি মনে হবে। আমাদের স্ট্রাগলের বা অবিচারে এক নমুনা পূর্বতন কাল্পনিক আয়েশা থেকে একরামুলের স্ত্রী আয়েশা পর্যন্ত বিস্তারিত। সেই অন্যায়ের দ্বারা নিপীড়িতের আয়েশাদের আর্তনাদ ধরার সামান্য আড়াল ধর্মী প্রচেষ্টা ফারুকীর ‘আয়েশা’।
‘আয়েশা’ দেখতে: